সুবর্ণলতা ( পঞ্চম পর্ব )

( ১ )

— ‘কি হয়েছে লতা ? এতো সকালে—’

মুকুন্দবাবুর প্রশ্নের উত্তরে কিছু বইলতে গিয়েও থমকে গেলাম । কি বইলবো আমি তুকে ভালোবাসি ? লাকি তুহার সাথে ঘর কইরবার স্বপন্ দেখি ? আচ্ছা আমি বিধবা বুলে , কি আমার ভালোবাসা টা সমাজের চোখে অচ্ছুত ? আর সমাজকে কি বুলবো , নিজের লিখা পড়া জানা ছেলেটাই বুঝলনি আমাকে । লক্ষী দিদির কথা ছেড়েই দিলাম । ছেলেটা ভুল বুঝে কাল মদ খেয়ে বাড়ী ঢুকেছে , সেই ছোটবেলার বাবুটা কোথায় হারিয়ে গেছে । সেই বাবু , যে ছোট বেলায় আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমোতো সেই এখন ঐসব ছাইপাঁশ গিলে এসে আমায় গালাগালি করলো । তবুও আমি ওর মা আর আমি মুকুন্দবাবুকে যেমন ভালোবাসি তেমনি বাবুর বাবাকেও ভালোবেসেছিলাম তাই আমি বাবুর বাবার কথা মতো , সবসময়—

—‘আরে এই লতা কি হয়েছে ? ঠিক আছিস —’
—‘হ্যাঁ , আমি ভালো আছি । আমি আর তুহার বাড়ি কাজ করবুনি । তুই মুকে ভুলে যা । ’

বুলতে বুলতে কেন জানি না , চোখ ফেটে জল বেরোতে লাগলো । যেমন ঠিক শীতের কুয়াশার মধ্যে বৃষ্টিটা কুনো অজানা কারণে চলি আসে ।

—‘ এই লতা শান্ত হ , আয় ঘরে আয় । ঘরে এসে ঠিক করে বল কি হয়েছে —’
—‘বুললাম তো তোর বাড়িতে আমি কাজ করবুনি । ’
—‘লতা আমি জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস । তুই যদি কাজ ছাড়তে চাস , আমি আটকাবো না । ’
—‘আমার ছেলেটা সব জেনে গেছে রে । তু জানিস ও কাল মদ খেয়ে এসে মুকে বাজে কথা শুনাইছে । আমার আর তো কেউ নেই রে ঐ সব । তুই এখন বুল কি করবো আমি ? আর আমিও তুকে খুব ভালোবাসি রে । ’

এবার আর পারলাম না চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো । মুকুন্দবাবু আমার মাথাটা কে নিজের কোলে টেনে নিল । তারপর আমার কপালে একটা চুমু খেল । কেমন যেন মনে হচ্ছে সবকিছু ভুলে আমি মুকুন্দবাবুর হয়ে যাই । ঠিক যেমন ঠান্ডা হাওয়াটা প্রত্যেক বর্ষায় শহরে ঢলে পড়ে ।

—‘দোরটা বন্ধ করবিনে বাবু ?’
—‘না থাক । দেখুক , সবাই সাক্ষী থাক । আজ সুবর্ণলতা ভিজুক । ’

( ২ )

আমি ঠিক করছি ? বাপটা অনেক আগেই মারা গেছে , তারপর থেকে মা টা সেই ছোট্ট থেকে মানুষ করেছে । মা একবারের জন্য মুখ ফুটে বলেনি তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা । শুধু বারবার বলে গেছে “তুকে অনেক বড়ো হতে হবে ”। আমার কি হয়েছে কি জানি ? কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে । মাঝে মাঝে মনে হয় সব ঠিক আছে আবার মনে হয় এসব ভুল । মুকুন্দবাবু লোকটা ভালো । মাকে কাল রাতে ওরকম কথা বলা উচিৎ হয়নি । না মার সাথে কথা বলতে , ক্ষমা চেয়ে নেবো । মা বোধহয় এখন মুকুন্দবাবুর বাড়ী কাজ করতে গেছে —

( ৩ )

বৃষ্টিটা আবার শুরু হয়েছে । সুবর্ণলতা যেন ধীরে ধীরে অবশ হয়ে যাচ্ছে । ফুলের পাপড়ির মতো ধীরে ধীরে সব আবরণ সরিয়ে সারা গায়ে বৃষ্টি মাখার জন্য তেরী হচ্ছে । মুকুন্দবাবু নাভি উন্মুক্ত , নাভীর নীচের পৌরুষত্বের তেজ ধীরে ধীরে বৃষ্টির ঝাপটার সাথে বাড়ছে । যেন কোনো এক আদিম বর্ষার ঐতিহাসিক মিলনের সূচণামুহূর্ত । বর্ষার তেজ বাড়তে লাগলো । সমগ্র প্রকৃতি যেন আজ তৃপ্তি পাওয়ার নেশায় মেতে উঠেছে । এরপর ধীরে ধীরে বর্ষার তেজ কমলো । দুটো ক্লান্ত শরীর একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হলো , শেষ আবরণ টুকুও অদৃশ্য হলো । এখন বিশ্রামের পালা , ঋতু বিশ্রাম—

……..এসবই বাইরে থেকে একজন দেখলো , একা , বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে । ঠিক যেমন বৃষ্টির সাক্ষী থাকে অন্যমনস্ক মানুষের দল—

(ক্রমশ)

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *