—‘কোই গো ? কোই গেলে ? আরে ঐ লতা এতক্ষণ ভোর হইছে ডাকিসনে কেন ? আরে এখনো সাড়া দেয়না । কি টা করছিস বলতো ?’
—‘আসছি , আসছি । কি হয়েছে বলো ? অতো চিৎকার করছিলে কেন ? ঘাটে ছিলুম , থালা-বাসন গুলো মাজতে হবে তো । ’
—‘তখন থেকে ডাকছিলুম , সাড়া দিসনি কেন ? চল চল দেরি করিসনি , কোদালটা নিয়ে আয় । মাঠ কোপাতে হবে । কাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে , এখন গিয়ে প্যাচকা তলা ফেলতে হবে । না হলে ধান সময় মতো বারাবেনি । আরে , হাঁ করে আমার মুখ দেখছিস কি ? বাবু উঠেছে ? পড়তে যাবেনি ? ’
—‘ হমম্ , বাবু উঠেছে । উঠে পড়তে চলে গেছে । ’
—‘বাহ্ , কে বলে চাষার ছেলে মানেই , পড়াশুনা করা যাবেনি । আমিও দেখিয়ে দেব , আমার বাবুকে অনেক বড়ো করব । অনেক অনেক—’
—‘আহা চটছো কেন ? লোকে তো অনেক কিছুই বলবে ? তুমি মাথা গরম করছো কেন ? চলো চলো অনেক দেরি হয়ে গেছে । ’
—‘হমম্ , চল চল। ’
আমার নাম লতা । আমার একটা ভালো নামও আছে,সুবর্ণলতা । আমার স্বামীর নাম ? স্বামীর নাম মুখে নেওয়া যাবেনি , তাই বলতে পারবুনি । আমার এক ছেলে , নাম সনাতন , ৭ বছর বয়স । আমাদের পরিবারে সবাই মানে বাপ , কাকা সবাই চাষী । রোজ সকালে বাবুর বাবার সাথে চাষে হাত লাগাই । কাল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে । আকাশে ফড়িং গুলো পাগলের মতো ওড়াওড়ি করছে । গ্রামের রাস্তা , বর্ষায় কাদা হয়ে গেছে —
—‘কই রে লতা ? তাড়াতাড়ি পা চালা । পান্তা -ভাতের সাথে লঙ্কা এনেছিস তো ? সকালে বাবু কি খেয়ে পড়তে গেছে ?
—‘ অই তো কাল রাত্তিরের বাসি দুটো রুটি । ’
—‘হবেনা হবেনা । আরো পয়সা লাগবে । বাবুকে অনেক বড়ো করতে হবে । ’
সত্যিই , ঐ টুকুন পয়সায় আর ঘরবাড়ী কোতথেকে চলবে তারউপর বাবুর টিউশনির খরচ কোতথেকে আসবে । এবৎসর আবার লঙ্কা চাষ করেছিলুম , ঠিকমতো দাম ওঠেনি বলে লাভও হয়নি । কিন্তু বাবুকে যে পড়াতেই—
—‘সাবধানে দেখে আয় লতা । প্রথম বর্ষায় মনষা ঠাকুরের বাহনগুলা বারাবে । একবার পা ফেলে দিলে , আর দেখতে হবেনি—’
আমাদের গ্রামে প্রত্যেক বছর বর্ষাকালে ১০ থেকে ১২ জন সাপের কামড়ে মারা যায় । তার উপর আমাদের গ্রামে আলো আসেনি এখনো । হারকিনের আলোয় কয়টুকুন দেখা যায় । তও সবসময় রেশন তেল আসেনা ।
চারিদিকটা কেমন সবুজ সবুজ হয়ে আছে । পাখিগুলো আজ একটু বেশিই ডাকাডাকি করছে । আলপথ ধরে লতাপাতার জঙ্গল গুলো যেন সবুজ চাদর বিছিয়ে রেখেছে । সামনে বাবুর বাবা দেখে শুনে আগে আগে কাস্তে আর কোদাল নিয়ে যাচ্ছে । মানুষটা শুধু কাজ নিয়েই থাকে । কাজ পাগল মানুষ একটা । আমাকে তো আগের মতো ভালোবেসে দেখেই না । বোকা -হাঁদা কাজপাগল মানুষটা দ্যাখেওনি যে আমি ওর কিনে নিয়ে আসা কালো টিপটা পড়েছি । খালি দিনে কাজ আর রাতে ঘুম । এই যা নাকে নোলকটা পড়তে ভুলে গেছি—
—‘লতা , তুই এখন বোস । আমি কিছুটা মাটি কুপিয়ে দিই তারপর তকে ডাকবো । যা এখন আলে গিয়ে বোস । ‘
আমি আর কি করব , জমিনের আলের উপর গিয়ে পান্তা ভাতের জায়গা নিয়ে বসে পড়লুম । আকাশটা এখনো ভারি ভারি লাগছে মনে হয় আজকে আবার বোধহয় মুষলধারে বৃষ্টি হবে । আরে ওকি ! আলের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে ওপারের মাঠে যাচ্ছে । প্রথম বর্ষায় কই মাছগুলো গর্ত থেকে বার হয়েছে বোধহয় যাই গিয়া ব্যাটাকে ধরি । সবে হাত দিয়ে ধরতে যাব , তখনি হঠাৎ মাঠ থেকে বাবুর বাবা চিৎকার করছে আর পা টাকে হাতে ধরে , মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে ।
—‘লতা , লতা —’
এইটুকুন কথা কানে ঢুকেছিল । দেখলুম পাশ দিয়া একটা লম্বা কালো কেউটে সাপ—
—‘—মা মা , ও মা ও মা কি হয়েছে তোমার ? ঘুমের মধ্যে বাবাকে ডাকছো কেন ?’
স্বপ্নটা আবার ভেঙে গেল । আজ অনেক বৎসর হল এখনো বারবার স্বপ্নটা ফিরে আসে । একবার দেওয়ালে টাঙানো মালা পড়ানো বাবুর বাবার ছবিটাকে দেখে হাসলুম । না সকাল হয়েছে ,কাল থেকে বর্ষা শুরু হয়েছে , মাটি কোপানো শুরু করতে হবে—
(ক্রমশ)