সৃজন প্রেমে শ্রীময়ী

শীতকালের এক স্নিগ্ধ সকালে কলেজের পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে প্রতিদিনের মতো আজও পাথর দিয়ে চিঠিটা চাপা দিল শ্রীময়ী। আর প্রতিদিনের অভ্যাস মতো দেখে নিল কেউ আছে কিনা। আজও কাউকে দেখতে না পেয়ে পরের চিঠি পাওয়ার আশা নিয়ে সূর্যের মত নির্মল হেসে চলে গেল সে।
দৌড়ে আসতে গিয়ে শীতকালেও ঘেমে গেল  সৃজন। কিন্ত নাহ! ও আজও দেখা পেল না ওর স্বপ্নের প্রেমিকার। তবে চিঠিটা যথাস্থানেই ছিল। আজও চিঠিটা পড়ে হালকা হেসে তার উত্তর লিখে নিজের কাজে চলে গেল ও।
এইভাবেই প্রায় তিনমাস ধরে চিঠির মাধ্যমে লেখা দুটি গোপন মনের আদানপ্রদান চলেই যাচ্ছে। এরা কেউ দেখেনি একে অপরকে, চেনেও না পরস্পরের স্পর্শ  বা গলার আওয়াজ; তবে এক অদ্ভুত চিঠির বাঁধনে বাধা পড়ে আছে দুই মন।
শ্রীময়ী সবার কাছে পরিচিত এক পাগল সাহিত্যপ্রেমী হিসেবে, যার শয়নে স্বপনে বাস্তবে শুধু সাহিত্যের চরিত্র আর লেখক। তবে কেউ জানে না সে নিজেও একজন অসাধারণ লেখক; যার লেখা অন্ধকারে আলোর শিখা এনে দেয়, যার শব্দ চরম বেরসিককেও পাগল প্রেমিক বানিয়ে দেয়। অপরদিকে সৃজন Chemistry Department-এর টপার; যে রসায়নের জটিল সূত্র ছাড়া বাস্তব রসায়ন বোঝেনা। তাই শ্রীময়ীকে দেখলেই সে নানান  কঠিন সূত্রের বিপাকে ফেলে তাকে বিব্রত করতে চায়। দিনের বেশিরভাগ সময়ই সাহিত্য মগ্ন থাকায় শ্রীময়ী পড়াশোনায় খুব ভাল তা নয়; তাই তার ভাবনা যেন মহাকাশের সেই কালো গহ্বর যা গোটা দুনিয়ার কাছে শুধুই রহস্য।
বিকেলবেলা গাছের তলা থেকে চিঠিটা কুড়িয়ে কলেজের লাইব্রেরিতে গেল শ্রীময়ী।
— “স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর “পাতাঝরার মরশুমে” এখন পাওয়া যাবে?” বলে হন্তদন্ত হয়ে লাইব্রেরিয়ানের কাছে ছুটল সে। পাশের টেবিলে বসেই সৃজন অল্প মুখ তুলে বললো— “আবার সেই Psycho-টা এসে গেছে… ওর যে কবে সাহিত্যপ্রেম বন্ধ হবে!”
— “হবেনা রে হবেনা… এই প্রেম যে জন্মান্তর বাঁধনে বাধা। কী করে আলগা হবে বল?”, বলে মিষ্টি হাসি হেসে চলে গেল শ্রীময়ী। আর ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইল সৃজন ।

২৮শে জানুয়ারি…

প্রিয় রাধাচূড়া,
বসন্ত তার প্রেমের ছোঁয়া নিয়ে এ মলিন মনে কবে আসবে বলতো? প্রেমের নেশায় রাঙিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে হারালো কোথায়? এই কৃষ্ণচূড়ায় ভরা বিতানে কি তোমার দেখা মিলবে না?

ইতি,
তোমার কৃষ্ণচূড়া

২৯শে জানুয়ারি…

প্রিয় কৃষ্ণচূড়া,
শীতের শেষেই যে বসন্ত আসে তার প্রেমের ছোঁয়া নিয়ে আবিরের রঙে রাঙাতে। তবে না, আর অপেক্ষা নয় সরস্বতী পুজোর দিন আমি আমার  সাজানো বাগানে কৃষ্ণচূড়াকে দেখতে চাই।
ইতি,
তোমার রাধাচূড়া

৩১শে জানুয়ারি…

দুজনেই দুজনের কাছে আবদার রাখলো যেন সরস্বতী পূজোর দিন রাধাচূড়া হলুদ রঙের  শাড়িতে আর  কৃষ্ণচূড়া লাল রঙের  পাঞ্জাবীতে আসে।

১লা ফেব্রুয়ারী…

সরস্বতী পূজোর দিন সকালে যখন প্রেমিক-প্রেমিকারা যুগলে স্বাদ নিচ্ছে প্রেমের, তখন রাধাচূড়ার খোঁজে কৃষ্ণচূড়া এসেছে তারই কাছে। না! আজ ওখানে কোনো চিঠি নেই তবে এক অপরূপ সুন্দরী রাধাচূড়া হলুদ শাড়িতে আর খোলা চুলে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।
“রাধা!”, বলে হালকা স্বরে ডাকল সৃজন। শ্রীময়ী আসতে আসতে সামনে ঘুরল আর ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসি নিয়ে ধীরে ধীরে বললো “কৃষ্ণচূড়া”…

একে অপরের দিকে অবাক হয়ে তাকাল ওরা, তারপরেই ওদের চোখে ফুটে উঠল প্রেমের ভাষা। সেই অদেখা বাঁধন দৃশ্যমান হল যখন কৃষ্ণচূড়া জড়িয়ে ধরল ওর রাধাচূড়াকে আর কপালে আলতো চুমু খেয়ে বললো, “ভালোবাসি বড্ড ভালোবাসি…”

এত কাছে থেকেও দুজন দুজনের থেকে শতযোজন দূরে ছিল ওরা, অন্যভাবে প্রেমের বাঁধনে বন্দি হল ওরা। “ভালোবাসা “; এক অদ্ভুত শব্দ…
ওদের উপর ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়াগুলো গাইতে লাগল—
“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি।
তোমায় দেখতে আমি পাইনি।।”

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *