স্বপ্নীল

স্বপ্নীল তখন বিধ্বস্ত বুক নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে। এবারেও মেডিক্যাল এন্ট্রান্স ক্লিয়ার করতে পারলোনা স্বপ্নীল।

“তোর দ্বারা আর কিছু হবে না, সারাদিন শুধু ফোন ফোন আর ফোন। বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। চৌকাঠ মাড়াবিনা কোনদিন”

বাবার এই কথায় হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে অভিমানেই ঘর থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরে স্বপ্নীল সোজা তার ‘আনন্দ নিকেতন’ চলে এসেছে।
আকাশে তখন ঘন মেঘ জমেছে,  ছিঁটেফোটা বৃষ্টি কান্না ধুইয়ে দিচ্ছে স্বপ্নীলের।

না, বাবা মায়ের ইচ্ছে পূরণ করতে পারেনি স্বপ্নীল। তিন বছর পর পর চেষ্টার পরেও মেডিক‍্যাল এন্ট্রান্স ক্লিয়ার হয়নি তার। বাড়ির অত‍্যাধিক চাপে মানসিকভাবে সে বিধ্বস্ত গত তিন বছর ধরে।

সারাদিন কোচিং ক্লাস, আরোও পাঁচখানেক টিউশন করে প্রকৃতির ছোঁয়ার বাইরে সে যেন কুঁকড়ে শুকিয়ে গেছিল।

নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে সে তার জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রে বারেবারে হেরেছে। সাক্ষী থেকেছে রাতজাগা রাত, রং পেন্সিল, আঁকার খাতা‌।

কোচিং ক্লাস ফাঁকি দিয়ে একদিন সে স্বাধীনতা খুঁজতে বেরিয়ে পেয়েছিল ” Paradise House ” যেটাকে সে আনন্দ নিকেতন বলতো।

“Paradise House” একটি অনাথ আশ্রম। ওখানের কচিকাঁচাদের সঙ্গে সময় কাটানোর মধ‍্যেই সে স্বাধীনতার স্বাদ খুঁজে পেয়েছিল স্বপ্নীল।

স্বপ্নীলের সমস্ত মনখারাপের কারণ, কষ্ট, বাড়ির চাপ যেন এক নিমেষেই গলে যেত ওদের একবার দেখলে।

খুদে বাচ্চাদের জন‍্য পকেটমানি বাঁচিয়ে চকলেট, পড়াল বই এসব দিয়ে সে হৃদয়ের এক অনাবিল আনন্দ সুখ পেত।

এরকমভাবে সে অল্প স্বাধীনতা আর জীবনের মানে খুঁজতে প্রায়ই আসতে থাকতো তার আনন্দ নিকেতনে। তার বাবা মা এর কিছুই টের পায়নি কোনদিন। ভয়ে বলতে পারেনি স্বপ্নীল। স্বাধীনতা হারাতে কার ভালো লাগে!

ছোটোবেলা থেকেই খুব ভালো ছবি আঁকতো স্বপ্নীল। “Paradise House” এর কচিকাঁচাদের ছবি আঁকা শেখাতো সে। আঁকা শিখিয়ে খুব মন ভরতো তার।

আজ স্বপ্নীলের মন খারাপ। বুকে যেন আস্ত পাথর চাপা রয়েছে। কিন্তু আজকেও তার আনন্দ নিকেতনের দরজা খোলার পরে একটা মৃদু বাতাসে বুকের ওপর পাথরটা নিমেষেই সরে গেল। বরাবরের মতো এবারও হাসি ফুটলো তার মুখে।

এদিকে ঘড়ির কাঁটায় সময় বাড়ছে। বৃষ্টির পর সমস্ত রং ধূসরে মিশেছে সন্ধ‍্যের শাঁখের পবিত্র আওয়াজে।

এখনো বাড়ি ফেরেনি স্বপ্নীল। তার বাবা মায়ের টেনশন বাড়তে শুরু করলো। আজকালকার ছেলে তো।

বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়দের ফোন করেও যখন খোঁজ মিললো না স্বপ্নীলের । তখন তার বাবা বেরোলেন খোঁজ করতে। হন‍্যে হয়ে খুঁজতে থাকলো তাকে।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানারকম আজেবাজে চিন্তাভাবনা আসতে থাকলো স্বপ্নীলের বাবার মাথায়। এখন যেন ছেলেকে ফিরে পেলেই হলো।

ভিড় রাস্তার মধ‍্যে হাঁটতে হাঁটতে তার বাবা দেখলো রাস্তার মাঝে পড়ে আছে নিথর দেহ, একদিক থেকে রক্ত পড়ছে অনবরত। কাঁধে একটা ব‍্যাগ। ব‍্যাগটা দেখেই চিনতে পারলেন ওটাই স্বপ্নীল।

কয়েক মূহুর্ত্তের জন‍্য পরিবেশটা যেন শান্ত হয়ে গেল।

ব‍্যাগটা খোলা মাত্রই স্বপ্নীলের বাবা পেলেন একটি কাগজ যার মধ‍্যে পেন্সিলে আঁকা একটি বাড়ির ছবি। ওপরে লেখা ‘আনন্দ নিকেতন’  আর কাগজের উল্টোদিকে লেখা চারটি লাইন-

“আমি জীবন খুঁজে পেয়েছি সর্বহারা ওদের হাসিমুখে
ঘরবন্দি আমার ইচ্ছেগুলো যেখানে বাঁচে স্বাধীন সুখে।
কোনদিন হঠাৎ মৃত‍্যু হলে খুঁজো না আর চার দেওয়ালের ভীড়ে।
তখন আমি সুখী হয়ে বেশ আছি তারার সঙ্গে মিশে।”

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *