“আমি নারী বলে আমাকে ভয় করো না? বিদ্যুৎশিখার হাত দিয়ে ইন্দ্র তাঁর বজ্র পাঠিয়ে দেন৷“
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্বাধীনতার ৭১ বছর পরেও সমাজে বিভিন্নক্ষেত্রে নারী পুরুষের অসম্যতা বর্তমান। তাও ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, নারী কেবল পুরুষের পদধূলি না হয়ে থেকে তাঁর বীরত্বের পরিচয় দিয়ে সমাজের বা রাষ্ট্রের উন্নতিকল্পে এগিয়ে এসেছে বহুবার৷
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এরকম বহু নারী বিপ্লবী আছেন যারা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন মাতৃভূমির উদ্দেশ্যে, নিজেদের রক্ত দিয়ে এঁকেছেন স্বাধীনতার স্বপ্ন৷ এদের মধ্যে অন্যতমারা হলেন—
ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ
(১৮২৮-১৮৫৮)
১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে মণিকর্ণিকা বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেন৷ পরবর্তীকালে তাঁর সাথে ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাও-এর বিবাহ হয়৷ বিবাহের পর তিনি রানি লক্ষ্মীবাঈ নামে ভূষিত হন৷ গঙ্গাধর রাও-এর মৃত্যুর পর লর্ড ডালহৌসি গঙ্গাধরের উত্তরাধিকার স্বত্ত অস্বীকার করে ঝাঁসি গ্রহণ করতে উদ্যত হন৷ ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহী সৈন্যরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলে লক্ষ্মীবাঈও ঝাঁসি উদ্ধারে তাঁদের সাথে যোগ দেন৷ বীরবালা স্বয়ং তরবারি বর্ম নিয়ে ঘোড়ার পিঠে যোদ্ধাবেশে সজ্জিত হয়ে রণচন্ডীর রূপ নেন৷ ‘মেরি ঝাঁসি দেঙ্গে নেহি’ তাঁর এই হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে ইংরেজ শাসক৷ ভারতমাতার বীর কন্যাসন্তান ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ২৯ বছর বয়সে যুদ্ধক্ষেত্রে বিপক্ষের গুলির আঘাতে ভারতমাতার কোলে নিদ্রা নেন৷
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
(১৯১১-১৯৩২)
তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের মাস্টারদা সূর্য সেনের দলের অন্যতম মহিলা বিপ্লবী৷ ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে ৮ জন সঙ্গী নিয়ে তিনি ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করেন, সেখানে রক্ষীদের আঘাতে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হন৷ সঙ্গীরা সবাই পালিয়ে যাওযায় প্রীতি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে বীরবিক্রমে মৃত্যু বরণ করেন৷
মাতঙ্গিনী হাজরা
(১৮৭০-১৯৪২)
মাতঙ্গিনী হাজরা ছিলেন মেদিনীপুরের এক মহীয়সী বীরাঙ্গনা৷ ১৮ বছর বয়সে বিধবা হলেও দেশের প্রতি তাঁর ছিল নিবিড় ভালোবাসা৷ কংগ্রেসের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে তাঁকে কয়েকবার কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয়৷
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে আগষ্ট আন্দোলনে মেদিনীপুরে এক বিরাট মিছিলের সর্বাগ্রে তিনি জাতীয় পতাকা হাতে নেতৃত্ব দেন৷ মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় পুলিশের গুলি লাগা সত্ত্বেও তিনি জাতীয় পতাকা ভূমিস্থ হতে দেননি৷ অবশেষে পুলিশের আরেকটি গুলির আঘাতে বন্দেমাতরম উচ্চারণের মাধ্যমে ভারতমাতার কোলে লুটিয়ে পড়েন এই বীরাঙ্গনা৷
লাবণ্যপ্রভা দত্ত (১৮৮৮-১৯৭১) ও শোভারাণী দত্ত (১৯০৬-১৯৫০)
১৯৩০-১৯৩২ সালে লাবণ্যপ্রভা দেবী আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করেন৷ কন্যা বিপ্লবী শোভারানি দত্তের সহায়তায় ‘আনন্দমঠ’ সামাজিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন৷ পাঁচবছর লাবণ্যপ্রভা দত্ত প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভানেত্রী ছিলেন৷
বীণা দাস ভৌমিক
(১৯১১-১৯৮৬)
‘ছাত্রী সংঘ’ ও সুভাষচন্দ্রের সাথে পরিচয় ছিল তাঁর৷ বি.এ ডিগ্রি নেবার সময় কনভেকশন হলে তিনি যে দুঃসাহসিক কাজ করেন, তার জন্য ৯ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেন৷ ১৯৪২ সালে কলিকাতা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক থাকাকালে গ্রেপ্তার হয়ে ৩ বছর বন্দী থাকেন৷
অ্যানি বেসান্ত
(১৮৪৭-১৯৩৩)
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই ইংরেজ নারীর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে৷ তিনি কংগ্রেস যোগদান করে ‘হোমরুল আন্দোলন’ শুরু করেছিলেন৷ এই আন্দোলন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বিশাল জনপ্রিয়তা লাভ করে৷
মাদাম ভিকাজী রোস্তম কামা
(১৮৬১-১৯৩৬)
তিনি ছিলেন একমাত্র বিদেশে বিপ্লববাদী নায়িকা৷ ইংল্যান্ডে ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকা সম্পাদন করেন৷
হেমপ্রভা মজুমদার
(১৮৮৮-১৯৬২)
১৯২১ সালে তিনি কংগ্রেসে যোগদান করেন৷ তাঁর স্বামী বসন্তকুমার কুমিল্লা জেলার যুগান্তর পার্টি সংগঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন৷
এছাড়াও ননীবালা দেবী,দুকড়িবালা দে, জ্যোতির্ময়ী গঙ্গোপাধ্যায়, অনুরূপা দেবী, মোহিনী দেবী, তরলিকা দেবী, প্রফুল্লনলিনী ব্রহ্ম প্রমুখ নারীরাও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন৷
নারী স্বাধীনতা সংগ্রামীরা অতীতে যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল সেই বীরত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে এখনকার নারীরা সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে এগিয়ে চলেছে পুরুষের পায়ে পা মিলিয়ে৷ শুধুমাত্র পুরুষতান্ত্রিক বা শুধুমাত্র নারীবাদী দিয়ে সমাজ এগোয় না, সমাজ এগোয় যখন আমরা সবাই সবাইকে সম্মান দিয়ে একসাথে দিনগুলোতে বেঁচে থাকার লড়াইটা জারি রাখি৷
আজ ৬৯-তম প্রজাতন্ত্র দিবসে দেশের সেই বীরবালাদের আমরা সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই৷