আজ ২২শে শ্রাবণ। রবিঠাকুরের ৭৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২শে শ্রাবণ ইংরেজি ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট ৮ বছর বয়সে মারা যান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মৃত্যু তাঁর কাছে গীতসুধারসে আসেনি। জগতে মাধুরী ছড়িয়ে দিয়ে তাঁর অন্তরের মাধুরী যদিও কমেছিল না, কিন্তু শারীরিক কষ্ট পেয়েছেন। তবে যাবার আগে পর্যন্তও রবিঠাকুর সৃষ্টিশীল ছিলেন। মৃত্যুর সাতদিন আগে রবিঠাকুরের লেখা,’তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছো আকীর্ণ করি’। মৃত্যুর আগে থেকেই তিনি অসুস্থ ছিলেন তবুও থামেনি তাঁর লেখনি। আরও নতুন নতুন সৃষ্টিতে মেতে উঠেছিলেন তিনি।
১৯৩৭ সালে কিডনির সমস্যাটা গুরুতর আকার ধারণ করে। তাঁর শরীর সায় দিচ্ছে না তবুও তিনি ১৯৪০ সালে তার পুত্রবধূকে নিয়ে কালিম্পঙে যান। কিন্তু বেশিদিন সেখানকার জল আবহাওয়া সহ্য হল না রবিঠাকুরের। ২৬শে সেপ্টেম্বর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছিলেন না কবিগুরু। দার্জিলিং থেকে এলেন সিভিল সার্জেন। শারীরিক পরীক্ষা করে বললেন,”অবিলম্বে অস্ত্রোপচার করা দরকার নইলে প্রাণ সংশয় হতে পারে।” কিন্তু প্রতিমাদেবী ও মৈত্রেয়ীদেবী কেউই অস্ত্রোপচারের পক্ষপাতী ছিলো না।
একটু সুস্থ হতেই কলকাতা ফিরিয়ে আনা হল। কিন্তু তিনি কলকাতা নয় শান্তিনিকেতনে ফিরতে চাইলেন। ১৯১৬ সাল থেকে রবিঠাকুরের চিকিৎসা করছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক নীল রতন সরকার। তিনি কোনোদিনও কবির অস্ত্রোপচারের পক্ষপাতী ছিলেন না। ১৯৪০ সালে কবি যখন অসুস্থ হন তখন নীল রতন সরকার গিরিড-তে ছিলেন। তখন রবিঠাকুরের শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে দেখলেন বিখ্যাত চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায়। তিনি সায় দিলেন অস্ত্রোপচারের। কবিকে জানানো হয়েছিল অস্ত্রোপচার করলেই তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন। এত বড়ো সিদ্ধান্তের কথা কিন্তু নীল রতন সরকার জানতে পারেন নি কারণ তিনি তখন কলকাতায় ছিলেন না।
এটাও পড়ুন: কাদম্বিনী গাঙ্গুলী প্রথম নারী চিকিৎসক হয়ে ওঠার লড়াই
অবশেষে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতেই রবিঠাকুরের অস্ত্রোপচার হয়েছিল। কিন্তু তাঁর অস্ত্রোপচারের পরেও কবিগুরু সুস্থ হন নি। তাঁর শারীরিক অসুবিধা আরো বাড়তে থাকে এবং তা মাত্রা ছাড়া হয়ে যায়। ৫ই এবং ৬ই আগস্ট কবির শারীরিক অবস্থা অবনতি হতে শুরু করলো। সেই অবস্থার কথা ধীরে ধীরে লোকেরা জানতে পারলো। আকাশ বাণীতে প্রতিনিয়ত তার অবস্থার খবর দেওয়া হচ্ছিল। এরপর ২২শে শ্রাবণ সকাল ৯টার দিকে কবিকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে রবিঠাকুরের শরীর আরো অবনতি হতে শুরু করে। ১২টা ১০ মিনিটে পুরোপুরি থেমে যায় রবিঠাকুরের হৃদ স্পন্দন।
ঠাকুর বাড়িতে তখন ভেঙে পড়েছে মানুষের ভিড়। জোড়াসাঁকোয় তিল ধারণের জায়গা নেই, বাইরেও অপেক্ষমান লক্ষ লক্ষ মানুষ। সকলেই কবিগুরুকে শেষবারের জন্য কাঁধে নিতে চান। জোড়াসাঁকোর যে ঘরে কবি ছিলেন সেখান থেকে তাঁকে বের করার উদ্যোগ হতেই এগিয়ে আসে সারিসারি কাঁধ। কেউ বিশ্ব চরাচরে রহস্য ভেদকারী মহানকবির শবদেহকে নীচে নামতে দিতে রাজি নন। শহরের রাজপথ রবিঠাকুরের অন্তিমযাত্রায় সামিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। গুরুদেবের শেষ যাত্রার পালকি নির্মাণ করেছিলেন নন্দ লাল বসু। সোনার বুটি দেওয়া চাদর পাতা হয়েছিল ঐ পালঙ্কে। ‘রাজার রাজার অন্তিম যাত্রা’ বলেছিলেন নন্দ লাল বসু। সেদিন শোকার্ত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে লিখেছিলেন,
‘দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্তপারে কোলে
বাংলার কবি শ্যাম বাংলার হৃদয়ের ছবি তুমি চলে যাবে বলে শ্রাবণের মেঘ ছুটে এলো দলে দলে।’
শ্রাবণের ধারার মত সব পথ এসে মিলল নিমতলা শ্মশানঘাটে। সেখানেই জ্বলে উঠল চিতা। সেই চিতায় ভস্মীভূত হল রবিঠাকুরের দেহ। কিন্তু কান্না হাসির দোলা দোলানো আমাদের প্রতিটা মুহুর্তে রয়ে গেলেন তিনি।