(আমার নাম তিতির । আমার বয়স ১৮ । আমি ছোট থেকে social anxiety disorder এর শিকার । আমি ভাবতে ভালোবাসি । আর এটা হল আমার গল্প । )
—‘অ্যাই তিতির কোথায় যাচ্ছিস আবার ?’
(উফফফ্ মা টা না সবসময় আমার পিছনে পড়ে আছে । কি যে ভাবে আমায়)
—‘মা একটাই তো যায়গা আছে , পার্ক । উফফফ্ , সবসময় এমন করো না । আমি কি বাচ্চা ?’
—‘সেই তো অনেক বড়ো হয়ে গেছিস তুই । আমাকে তোর কিসের প্রয়োজন । তোর যখন ছেলে মেয়ে হবে বুঝবি । আর আজ থেকে তোর ডাঃ রায়ের কাছে counseling শুরু । ঠিকসময় মতো চলে এসে আমায় উদ্ধার করো । এই কথাটা শুনেছিস ? উত্তর না দিয়ে চলে যাচ্ছিস যে —’
(মা কে যে কি করে বোঝাবো ? মা ভাবে আমি পাগল । আরে বাবা কোনো মানুষ যদি একা থাকতে ভালোবাসে , চুপচাপ থাকে তার মানে কি সে পাগল ? ধুরররর্ , ভালো লাগে না )
একটা ট্যাক্সি ধরলাম পার্কে যাওয়ার জন্য । ট্যাক্সির কাঁচের জানলা দিয়ে আবছা শহরটা কে কেমন অচেনা লাগছে ঠিক যেমন , বহু পুরোনো কোনো স্মৃতিকে হাতড়ে বেড়ানোর মতো । ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে । ট্র্যাফিকের ঐতিহাসিক লালবাতিটা আমায় ধৈর্য্যের পরীক্ষায় বসিয়ে দিল । যথারীতি বুড়ি ভিখারী , খবরের কাগজ বিক্রী করা বাচ্চা ছেলেটা , ফুলের তোড়া বিক্রি করা বাচ্চা মেয়েটা রাস্তায় নামলো । ফুলের তোড়া বিক্রি করা বাচ্চা মেয়েটা আমার গাড়ির দরজায় এসে , ছোট ছোট আঙুল দিয়ে টোকা মারলো । আমি কাঁচটা নামালাম —
—‘দিদি , একটা ফুল নিয়ে যা না । মাত্র ১০ টাকা । নাহলে বাবা মারবে । ’
আমি ১০ টাকা দিয়ে একটা ফুল কিনে আমার ডায়েরির পাতার ভেতরে ঢুকিয়ে রাখলাম ।
(আচ্ছা এই যে বাচ্চাটি যে ফুল বিক্রী করছে , এ কি কখনো ভেবেছে ? যে একটা দিন যেখানে বাবা , মায়ের পাশে শুয়ে আছে , রাতে মা মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে আর রূপকথার গল্প শোনাচ্ছে । ভেবেছে হয়তো বা এখনো ভাবে কিন্তু মানুষের জীবনের স্বপ্ন গুলো বেশিদিন টেকে না , বাস্তব নামক ঢেউ এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায় । আচ্ছা কখনো ও হেসেছে ? মানে সত্যি কারের মন থেকে হাসি । হাসিটা বোধহয় ওর কাছে কোনো এক অবাধ্য হাওয়া , যে আসে ওকে ভাবায় , ও ধরতে গেলে হারিয়ে যায় । )
—‘এই শোনো —’
মেয়েটা আবার কাছে এলো । এবার ভালো ভাবে দেখলাম । শুষ্ক মলিন চোখ দুটো—
—‘হ্যাঁ দিদি বলো । ’
—‘এই নাও এই ফুলটা তোমার জন্য । উহু পয়সা লাগবে না , এমনি দিলাম—’
(মেয়েটা হাসলো । ফেসবুকে পোস্ট বেরোয় একটা “ uffff ,that smile,,that damn smile—” )
পার্কে নামলাম । একটা একদম ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসলাম । উফফফ্ এখানটা বেশ চুপচাপ । কিন্তু ভাগ্যটা বরাবরি আমার খারাপ । কোথা থেকে একটা couple চলে এলো , এলো তো এলো এসে ঝগড়া শুরু করো করলো ।
(উফফ্ শান্তি নেই । আচ্ছা এরা ঝগড়া করছে কেন ? এরা তো নিজেদের ভালোবাসে । অবশ্য আমি কখনো কাউকে ভালোবাসিনি একমাত্র মা বাবা ছাড়া । অথবা হয়তো কেউ ভালোবাসতে চেয়েছিল , আমিই আসতে দিইনি । উফফ্ কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে গেলাম । এখনো ওরা ঝগড়া করছে । ঠিক যেমন একটা ফুটপাত অঝোর বৃষ্টির সাথে ঝগড়া করে কিন্তু সেই তো শেষে দুজনেই ভিজবে । কেউ ভিজবে অভিমানে , আর কেউ ভালোবাসায় । আসলে ভালোবাসায় ঝগড়া খুব দরকারি যতটা দরকারি সর্ষে ইলিশে , সর্ষের থাকাটা । আসলে সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী আজ থেকে ১০ বছর পর এরা এই ঝগড়ার কথা মনে করবে আর মুচকি হেসে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে । উফফ্ আমি এসব কি ভাবছি ? আমায় ফিরতে হবে যে , নাহলে এবার মা নির্ঘাত—)
ডায়েরিটা বন্ধ করলাম । সন্ধে হয়ে এসেছে । কেমন যেন শির শিরানি ভাব । ঝিঁঝিঁ পোকা গুলো ডাক শুরু করেছে । বৃষ্টিটা এখন বন্ধই আছে । কেমন যেন একলা একলা ভাব চারিদিকে । খুব দুরে বোধহয় কোনো একদল ছেলে মেয়ে গান গাইছে , গানটা খুব চেনা—
“ ওরে ছেড়ে দিলে সোনার গৌড়
খ্যাপা ছেড়ে দিলে সোনার গৌড়
আমরা আর পাব না, আর পাব না —”
(না তিতির আর বেচে নেই । এটা তিতিরের বেঁচে থাকা অবস্থায় হারিয়ে যাওয়া একটা গুরুত্বহীন কাহিনী)