এমনিতেই পাহাড় মানে রহস্যময় এক অমোঘ সৌন্দর্যের হাতছানি। আর সেখানে যদি খুন-খারাপি হতে শুরু করে, তবে তো কথাই নেই। রহস্যের পারদ অচিরেই নিজের সর্বোচ্চ সীমা পার করে যাওয়ার ধৃষ্টতা দেখায়। তাই নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ছয়টা নিরুদ্দেশের রিপোর্ট, আর ঠিক তার পর পরই পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গা থেকে সেই ছয় ছয়টা মৃতদেহের সন্ধান পাওয়ার ঘটনা বেশ চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল কালিম্পঙের স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষকে। তদন্ত চলছিল জোর কদমে, কিন্তু সূত্র বলতে একটাই। মৃতদের মুখে এমনভাবে রঙের হদিশ পাওয়া গিয়েছিল যেন জোর করে তাদেরকে পেইন্ট খাওয়ানোর চেষ্টা হয়েছে, এবং গলায় ফাঁস দিয়ে চা-বাগানের ঢালে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
ওদিকে সময়টা তখন দশমীর পরদিন সন্ধ্যেবেলা। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী উষ্ণীষ সেন বিজয়া সম্মীলনীর মঞ্চে উঠে মাইক হাতে গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, “সাফল্য বলতে আমার কাছে একটাই নীতি, মাই ক্রিয়েটিভ আর্ট ওয়ার্ক মাস্ট বি ইউনিক।” কথাটা শুনেই শিল্পীর গুণমুগ্ধ ভক্তেরা দর্শকাসন থেকে মুহুর্মুহু হাততালিতে ভরিয়ে দিচ্ছিলেন শিল্পীকে। শিল্পী কিন্তু বড্ড সচেতন ও স্বল্পভাষী। অল্পকিছু কথায় নিজের বক্তব্য শেষ করেই নেমে গিয়েছিলেন স্টেজ ছেড়ে। আর ঠিক তখনই ঘটেছিল আশ্চর্যজনক ঘটনাটা। স্থানীয় থানার পুলিশ এসে রীতিমত হাতকড়া পরিয়ে টেনে নিয়ে গিয়েছিল উষ্ণীষ সেনকে।
দর্শকদের মধ্যে তখন একরকমের চাপা উত্তেজনা, সবাই একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতেই ব্যস্ত, কিন্তু কারোর মুখেই কথা সরছে না। “একজন নিরীহ চিত্রশিল্পীকে কেনই বা অ্যারেস্ট করতে যাবে পুলিশ!”, এই প্রশ্নটাই প্রত্যেককে অস্থির করে তুলেছিল ওই মুহূর্তে। অথচ সাহস করে জিজ্ঞেস করে উঠতে পারছিলেন না কেউই। এবার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য ফিরে যাওয়া যাক প্রায় তিন বছর আগের প্রেক্ষাপটে। উঠতি চিত্রশিল্পীদের মধ্যে তখন উষ্ণীষ সেন অন্যতম। অসমের কোকরাঝারের আদি বাসিন্দা উষ্ণীষ যখন বাংলার মাটিতে পা রাখেন, তখন চিত্রশিল্পীদের জগতে খানিকটা মন্দা চলছে বলা চলে। পুরনো অভিজ্ঞ শিল্পীরা ততদিনে অবসর খুঁজে নিয়েছেন, আর যারা রয়েছেন তারা সকলেই উঠতি। প্রতিষ্ঠিত চিত্রশিল্পী বলতে সেই সময় কেউ নেই বললেই চলে। আর তাতেই শাপে বর হয়েছিল উষ্ণীষ সেনের।
নিজের শিল্পসত্তার জোরে খুব তাড়াতাড়িই মানুষের হৃদয়ে নিজের একটা পাকাপোক্ত জায়গা বানিয়ে নিয়েছিলেন শিল্পী উষ্ণীষ সেন। একদল মানুষ তো উষ্ণীষ সেনের নামে সেসময় রীতিমত পাগল। কিন্তু এই বাড়তে থাকা খ্যাতিই হয়তো কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল মানুষটার। নিজের পরিবারের সাথে কালিম্পঙের পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটা গ্রামে বাস করতে শুরু করেছিলেন উষ্ণীষ সেন। পাহাড়ি এলাকা বলে হুট করেই সন্ধ্যে নামার চল সেখানে। আর শীতকাল হলে তো কোনও কথাই নেই। সারাক্ষণ কুয়াশার চাদরে মুখ ঢেকে নিয়ে চা-বাগানগুলোর সাথে রীতিমত লুকোচুরি খেলা চলে পাহাড়ের। সে খেলার মাঝেই সুযোগ সন্ধানী মানুষগুলো দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য খুঁটিনাটি ব্যবস্থা করে নেয়। কিন্তু সে কারণে কখনও প্রকৃতির কোনরকমের ছন্দপতন হয়নি। প্রকৃতি নিজের বাৎসল্য উজার করে দিয়েছে ওই এলাকার প্রতিটি কোণায় কোণায়।
উষ্ণীষ সেনের বাড়িটা মূল শহর থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ, বেশ পুরোনো একখানা দোতালা বাড়ি। বাড়ির সামনে ও পেছনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা, এবং সামনের দিকে ছোট মতন একটা ফুলের বাগান। এই ফুলের বাগানের পরিচর্যা করেই সময় কেটে যেত উষ্ণীষ সেনের স্ত্রী বিশাখার। কিন্তু সেসব দিকে কোন হুঁশই ছিল না শিল্পীর। তিনি নিজের মতোই সারাক্ষণ ক্যানভাস আর রঙ-তুলির জগতে ডুবে থাকতেন। অনেক অনেক দিন তো স্নান-খাওয়া ভুলে সারাদিন নিজের আঁকার ঘরে পড়ে থাকতেন। এককথায় বলতে গেলে খ্যাতির হাতছানিতে আসক্ত হয়ে উষ্ণীষ সেন বাস্তব জীবন ভুলেছিলেন। এই আসক্তি তাঁকে কী ভীষণ বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল তা বুঝতে পারেননি শিল্পী। তিনি একের পর এক এঁকেই চলেছিলেন, আর নিজের ছবিগুলোর একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করার জন্য হন্যে হয়ে চেষ্টা করছিলেন।
উষ্ণীষ সেনের একটা অদ্ভুত অভ্যাস ছিল। তিনি যাই আঁকতেন, হয় সেসব অ্যাবস্ট্রাক্ট গোত্রভুক্ত, আর নয়তো সেসব ভীষণ রকমের ইউনিক। এমন কিছু যা সাধারণত দেখা যায় না। তাঁর এই অভ্যাসের জন্য তেমন কোন অসুবিধা না হলেও একটা সময় গিয়ে এই অভ্যাসই অভিশাপ হয়ে নেমে আসে শিল্পীর জীবনে। প্রথমবারের মত প্রদর্শনীর আয়োজন করার সুযোগ পেয়ে উষ্ণীষ সেন তখন ভীষণ উত্তেজিত। দিনরাত এক করে কাজ করে চলেছেন, এঁকে চলেছেন। নির্দিষ্ট দিনে সমস্তটা একা হাতে গুছিয়ে রীতিমত ভালোভাবে সফল করেছিলেন প্রদর্শনী। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার যে প্রদর্শনী চলাকালীনই অনেক গুণীজনের তরফ থেকে পোর্টরেইট আঁকার জন্য অনুরোধ ও উপদেশ এসেছিল শিল্পীর কাছে। তাই প্রদর্শনীর পর তিনি বুঁদ হয়ে মনোনিবেশ করেছিলেন পোর্টরেইট আঁকার ব্যাপারে।
তখন জানুয়ারির শীত, উষ্ণীষ সেন ডুবে নিজের নতুন ধরনের শিল্পকর্মের নেশায়। স্নান-খাওয়া ছাড়া নিজের আঁকার ঘর ছেড়ে তেমন বেরোতেন না তিনি, বিশাখার সাথেও দেখা-সাক্ষাৎ প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে ছিল। ওদিকে উষ্ণীষ সেনের বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে কালিম্পঙে তখন তোলপাড় চলছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ছয়জনের নিরুদ্দেশ হওয়ার রিপোর্ট জমা হয় স্থানীয় থানায়। প্রথমে কূল-কিনারা করতে না পারলেও রহস্যের সমাধান হয় পুজোর ঠিক আগ দিয়ে উষ্ণীষ সেনের দ্বিতীয় প্রদর্শনীর পর। সেখানে যে কয়টা ছবি রাখা হয়েছিল, তারমধ্যে ছ’টা ছবি ভীষণ ভাবে মিলে যাচ্ছিল ওই নিরুদ্দেশ ছয় ব্যক্তির অবয়বের সাথে। ততদিনে ওই ছ’জনের মৃতদেহও যথারীতি পাওয়া গিয়েছিল কালিম্পঙের বিভিন্ন এলাকা থেকে। তাই পুলিশের তরফ থেকেও দুইয়ে-দুইয়ে চার করে নিতে দেরী হয়নি। আর বাকিটা জানা যায় উষ্ণীষ সেনের জবানবন্দি থেকে। এভাবেই খ্যাতির নেশায় হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায় এক উঠতি চিত্রশিল্পীর জীবন।
কলমে: সুবর্ণা পঞ্চানন তক্ষক
Image Source: Google
The vibrant city of Kolkata is set to host an extraordinary musical event as renowned Indian music…
In a heartwarming ode to friendship and the unifying spirit of Pujo, SVF Brands has…
The year 2024 has not been what I had planned so far. Everything went downhill.…
Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…
Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…
This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…
This website uses cookies.