কয়েক দিন পরেই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো । সারাবছর ধরে এই পাঁচটি দিন এর জন্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি আমরা সবাই। ষষ্ঠী থেকে দশমী খাওয়া দাওয়া প্ল্যানিং হুল্লোড়ে কি ভাবে কেটে যায় সেটা বোঝা বড় মুশকিল। বাংলার মাঠে শোভা পাচ্ছে শরতের কাশফুল। আদরের উমা আসবেন তার বাপের ঘরে ।দিকে দিকে আনন্দের রোশনাই। মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত খুশির জোয়ারে ভাসবে সবাই। হাতিবাগান থেকে গড়িয়া হাট কিংবা ডায়মন্ড প্লাজা থেকে কোয়েস্ট মল পাঁচ দিনের ম্যাচিং জামা জুতো শাড়ি কেনার হাকাহাকিতে মুখর হয়ে থাকে শহর কলকাতা।দোকানে দোকানে কেনাকাটার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অনলাইন শপিং। মুঠোফোনের মধ্যেই রয়েছে সারা দুনিয়া ।একটা টাচেই পুরো বিশ্ব জগৎকে হাতের মধ্যে পুরে ফেলা যায়।জামাকাপড় থেকে কসমেটিকস সবই এসে যায় বাড়ির দোরগোড়ায়।
পুজোর একমাস আগে থেকেই নিত্য নতুন বিজ্ঞাপনে বেশ চমকে যেতে হয় শহরবাসীকে। শুধু থিমে থিমে নয় বিজ্ঞাপনী চমকেও বেশ লড়াই চলে প্রতিটি পুজো কমিটি ও মণ্ডপের মধ্যে।
কিন্তু এই বছরে বাদ সেধেছে করোনাসুর।আট থেকে আশি সকলেই ভীত আতঙ্কিত। মার্চ মাস থেকে একটার পর একটা মাস পেরিয়েছে দিন গুণে এই বুঝি রেহাই মেলে ভাইরাসের হাত থেকে।কিন্তু না সময় যত এগিয়েছে ততই করোনাতঙ্ক গ্রাস করেছে বাঙালি সহ সমগ্র দেশবাসী কে। চলতি মাসের ২২তারিখ ষষ্ঠী। হাতে মাত্র আর কয়েক দিন। অন্য সব বছরে প্যান্ডেলে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকে কলকাতা। চতুর্থী থেকেই মানুষের ঢল নামে পুজো প্যান্ডেলে।”Last minute shopping” এ মজে থাকে গোটা বাঙালি। কিন্তু করোনার দাপটে এবার কিছুটা হলেও ফিকে পুজো পুজো ভাব। একাধারে দুর্গাপুজোর আনন্দের হাতছানি অন্যদিকে করোনার ক্রুর চক্ষু এই দুইয়ের মাঝে পরে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা সকলের।তবে এই দুর্গা পূজার সাথে জড়িয়ে আছে হাজার মানুষের রুটি রুজি।.
ঢাকির সংসারেও হানা দিয়েছে করোনা। নরেন ঢাকির পাঁচ জনের দল প্রতি বছর কলকাতার বড় পুজোর বায়না পায় কিন্তু পাঁচ জন!!!! ওরে বাবা সেতো অনেক জন।ভয়ঙ্কর ভাইরাস দূরত্ব বাড়িয়েছে মানুষের মধ্যে। তাই কোভিড কালে তাইপুজোয় একজন ঢাকি ই বরাদ্দ।
অনেক মণ্ডপে বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে থাকে কুড়ি জন মেয়ে ঢাকির একত্রে বাজনা ও ধুনুচি নাচ।এবছর সেইসব বিনোদনেও প্রভাব ফেলেছে মারণ ভাইরাস।
তিন সন্তানের বাবা সুলেমান বছরের বাকি দিন গুলোয় মুনিশের কাজ করলেও দুর্গাপুজোর সময় সে প্যান্ডেলের কাজ নেয়।কিন্তু এবছর সব বড় বড় থিমের পুজোই ছোট আকার ধারণ করেছে সেই অর্থে হাতে কোনো কাজ নেই।
বছর চোদ্দর পম্পা আর ওর মা রঙিন মাটির পুতুল বানিয়ে কলকাতায় আসে পুজোয় বিক্রি করতে। এবার সরকারের নির্দেশে পুজোয় জনসমাগম করা যাবে না।পুজো প্যান্ডেলের চারপাশে মেলা ও বসবে না।এবারে পুজোর কটা দিনের উপরি উপার্জনে কোপ পড়ায় হতাশ পম্পা।
বিশরপাড়ার রেলবস্তির বাবুরাম ভালো ভেঁপু বানাতে পারে। প্রতিবার দুর্গাপুজোয় দুই ব্যাগ ভেঁপু নিয়ে দেশপ্রিয় পার্কের কাছে বসে। বাচ্চা বুড়ো সবাই হেঁটে ঠাকুর দেখার ক্লান্তি ভুলতে ওই ভেঁপু কিনে বাজায় ।কিন্ত এবার অনেক প্যান্ডেলেই বাইরের দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষেধ তাহলে পুজোর এই কয় দিন কোনো পয়সা হাতে আসবেনা বাবুরামের।তাই এবার সে ঠিক করেছে রঙিন মাস্ক বিক্রি করবে। করোনা আবহে এখন এটাই ইন।
হাবরার বাসিন্দা স্বপন বাবু পেশায় একজন দর্জি। অন্য বছরে পুজোয় দম ফেলার ফুরসত মেলেনা ।সপ্তমী অবধিও মাল ডেলিভারি থাকে। কিন্তু এই বছর হাতে কাজ খুবই কম।অনেকেই পুজোর যে পুজোর খরচে রাশ টেনেছেন।
মণ্ডপের পাশে ফুচকা ,ঘুগনি থেকে চাউমিন বিরিয়ানি খাওয়ার স্টলে ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেতে হতো বিক্রেতাদের। এবারে সেটাতেও কোপ। দূরত্ব বিধি আর sanitization এ সর্বদা লক্ষ্য রাখতে হবে। স্ট্রিট ফুড স্টলে সেটা কতটা বজায় থাকবে তা নিয়ে বেশ চিন্তিত বিক্রেতা রা।
খবর নিলে এরকম হাজারো মানুষের সমস্যার কথা জানতে পারবো যাদের অর্থ সংস্থানের একটা বড় উৎস দুর্গাপুজো।এবছর পুজোর রীতি নিয়ম থেকে ঠাকুরদেখা সব কিছুতেই কাটছাঁট হয়েছে তবুও বাঙালি কি এবার পুজোয় সংযত হবে??পুজোর চিরাচরিত চেনা ছবিটা কি আদৌ বদলাবে? নাকি মুখে মাস্ক হাতে sanitizer আর বুকে উদ্যম ও সাহস নিয়ে বেরিয়ে পড়বে প্রতিমা দর্শনে। নাকি এই পাাঁচ দিন অনলাইনে বা টিভির পর্দায় দশভুজাকে দেখে ভক্তি ভরে প্রণাম করবে? শোনা কয়েকটি যাচ্ছে পুজো কমিটি প্যান্ডেলে গিয়ে অষ্টমীর অঞ্জলিতেও কিছু বিধি নিষেধ রাখছেন । পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ শোনা যাবে মাইকে তাই ঘরে বসেই ফুল নিয়ে দু হাত জড়ো করে মা কে স্মরণ করে হবে অঞ্জলি। কোভিড পরিস্থিতিতে কোনো রিস্কই নিতে চান না তারা। দশমীর ভাসানও নিষেধাজ্ঞার ঘেরাটোপে।তাই
সামনে থেকে দেখা ঝলমলে আলোক সজ্জার পুজোমন্ডপ শুধু টিভিতে দেখে মন ভরবে কি বাঙালির? কোভিড আবহে বেশকিছু পুজো উদ্ভোধন ও ভার্চুয়ালে হবে তাহলে একই ভাবে মণ্ডপ দর্শন নয় কেন ?এর মধ্যেই হিডকো সহ তিনটি সরকারি সংস্থার উদ্যোগে ” গুলমোহর” নামে এই সংস্থা একটি অনলাইন পোর্টাল তৈরি করেছে যেখানে পুজোর পাঁচ দিন ষষ্ঠী থেকে দশমী অবধি ঠাকুর ও পুজো প্যান্ডেল দর্শন করা যাবে তাও একেবারে বিনামূল্যে।বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে চাক্ষুষ করা যাবে এই অনলাইন প্যান্ডেল হপিং। আপাতত এই পোর্টালের নাম দেওয়া হয়েছে দুর্গা ফেস্ট ডট কম।তাহলে এটাই কি হবে এই বছরের পুজোর নতুন ট্রেন্ড?
তবে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন অন্য বছরের মতো দুর্গাপুজোর আনন্দ উন্মাদনা যদি একই মাত্রায় এবারেও বজায় থাকে তাহলে পুজোর পর আছড়ে পড়তে পারে সংক্রমণের ঢেউ। এবার সত্যি যেন অন্য রকম পুজোর পাঁচটা দিন। অসুরনাশী দেবী দুর্গা কি পারবে করোনাসুরকে নাশ করে পুনরায় স্বস্তির আবহাওয়া ফিরিয়ে আনতে?আপামর বাঙালি মনে মনে দেবীর কাছে এই আকুল প্রার্থনাই করছে।শুধু প্রার্থনা নয় তার সাথে মানুষকে সাবধানতা ও সচেতনতাও অবলম্বন করতে হবে।আপাতত এই কটা দিন এই টুকুই যে করণীয়।