ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে শিক্ষকদের জন্য একটা আলাদা পরিসর তৈরি হয়ে যায়। লোকে যেটাকে শ্রদ্ধা বলে, আমি সেটাকে আরেকটু সহজ করে বলি ভালবাসা। একটা সময় থাকে যখন আমরা আমাদের প্রিয় কোন এক শিক্ষককে অনুসরণ করতে শুরু করি। কিন্তু এই অনুসরণে শিক্ষকের মূল্যায়ন সম্ভব নয়। শিক্ষকের ভাবধারা এবং শিক্ষা যখন ছাত্রদের মধ্যে অনুরণন হয়, ঠিক তখনই শিক্ষকের সাফল্য। ছাত্রের মধ্যে যখন শিক্ষক নিজের দেওয়া নীতিশিক্ষার প্রতিফলন দেখতে পাবে, তখনই একজন শিক্ষক মনে করতে পারেন যে তার দেওয়া শিক্ষা সম্পূর্ণ। এবং এই সম্পূর্ণতা আসবে কার্যক্ষেত্রে সেই নীতিশিক্ষার পর্যাপ্ত প্রতিফলন হলে। আজ দেশজুড়ে মহা ধুমধামে পালিত হচ্ছে শিক্ষক দিবস। সেই উপলক্ষ্যে দেশের সকল শিক্ষকদের LaughaLaughi’র তরফ থেকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা। কিন্তু প্রশ্ন হলও, শিক্ষক দিবসের দিনে বরুণ বিশ্বাসের প্রসঙ্গ আসবে কেন? কে এই বরুণ বিশ্বাস?
উত্তর চব্বিশ পরগনার শুটিয়া গ্রামের বরুণ বাংলায় স্নাতক এবং B.ed ডিগ্রিধারী এক তরুণ। যিনি WBCS-এর মত লোভনীয় চাকরির প্রলোভন হেলায় উড়িয়ে দিয়ে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতার পেশা। পেশা বললে ভুল হবে হয়তো। শিক্ষকতা আর পাঁচটা চাকরির মত চাকরি নয়। একটা প্রজন্মের মেরুদণ্ড এবং দেশের ভবিষ্যতকে গড়ে তোলার কাজটা আর যাই হোক ছাপোষা পেশা নয়। বরুণের মধ্যেই ছিল শিক্ষার দেওয়ার একটা আদিম প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তি ডিগ্রির ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে মানসিকতার ওপর। কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউশনে আমৃত্যু শিক্ষকতা করেছিলেন বরুণ বিশ্বাস। হ্যাঁ আমৃত্যু! বরুণ ছিল, আর নেই। তার নশ্বর দেহের পোড়া ছাই, কোন শ্মশানের কালো মাটিকে ধুসর আবরণের পরত পরিয়েছে সেই কবেই। কিন্তু সত্যিই কি বরুণ নেই? বরুণ বিশ্বাসের মানবিক চেতনা কি এত সহজে হারিয়ে যেতে পারে?
আজ সেপ্টেম্বরের ৫। পিছিয়ে যান ৫ টা বছর। সাল ২০১২, ৫ই জুলাই, সন্ধ্যে ৭টা বেজে ২০ মিনিট। আপনি যখন অফিস থেকে ফিরে AC চালিয়ে, সবে টিভিটা চালিয়েছেন। ঠিক তখনই গোবরডাঙ্গা স্টেশনের বাইরে বরুণ বিশ্বাসের পিঠে গুলি করে অজ্ঞাতপরিচয় কিছু যুবক। মুহূর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্রতিবাদের জ্বলন্ত ভাবমূর্তি বরুণ বিশ্বাস। কেন খুন হয়েছিলেন বরুণ? এককথায় বলতে গেলে, কারণটা হল, বরুণ বিশ্বাস নিপীড়িতদের পক্ষে ছিলেন, নিপীড়কদের পক্ষে নয়। আর যুগে যুগে নিপীড়িতরাই নিষ্পেষিত হয়েছে আর তাদের পক্ষের মানুষদের শুইয়ে দেওয়া হয়েছে চিরনিদ্রায়।
‘Man who gave the poor a voice now silenced’- Indian Express
নব্বইয়ের দশকে শুটিয়া গ্রামকে ধর্ষণের রাজধানী বললে, খুব একটা ভুল বলা হবেনা হয়তো। ২০০০ সালে বরুণ আরও কিছু সহকারীর প্রচেষ্টায় স্থাপন করেন “ গনধর্ষণ প্রতিবাদ মঞ্চ ’’। সেই থেকে শাসকের বিরুদ্ধে , শোষণের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে গেছে বরুণ। কত ধর্ষিতা নারীর বিচার পাইয়ে দিয়েছে, কত গরিব ছাত্রকে নিজের খরচায় পড়িয়েছে, কত আর্তের হাতে তুলে দিয়েছে নিজের উপার্জনের শেষটুকু, অন্যকে নিজের বিছানা দান করে নিজে শুয়েছে মাটিতে। গ্রামের মানুষগুলোর সামনে প্রতিটি ঝড়ে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বরুণ। এহেন বরুণের মৃত্যুর সময় একটা মানুষও এগিয়ে আসেনি সাহায্যের জন্য। পুলিশ কেসের ভয়ে পিছিয়ে গেছে যে প্রত্যক্ষদর্শীরা, তাদেরই হয়তো কারও ছেলের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছিল বরুণ। যে লোকটা দুষ্কৃতিদের খবর দিয়েছিল বরুণের উপস্তিতির, সেই লোকটাই মৃত্যুর কদিন আগে খাবারের জন্য বরুণের সামনে হাত পেতেছিল। বরুণ ফেরায়নি, শিক্ষকেরা ফেরায় না।
অভিযুক্ত ভাড়াটে খুনি সুমন্ত দেবনাথ ওরফে ফটকে, দেবাশিষ সরকার, বিশ্বজিৎ বিশ্বাস ও রাজু সরকার, এদের সকলেই ছাত্র। এখানে একটা প্রশ্ন জাগে, বরুণ বিশ্বাস কি তবে অসফল? সে কেন এই ছাত্রদের সঠিক শিক্ষা দিতে পারেনি? আমার এক স্যার বলতেন, কাঁধে লোম গজিয়ে গেলে কাউকে আর কিছু শেখানো যায়না। তখন সে যদি নিজে থেকে শিখতে চায় তবেই সে ঠিক আর ভুলের পার্থক্য করতে শিখবে। এই কথাটা কতদূর ঠিক, আমি জানি না। কিন্তু সত্যি কি প্রতিবাদ করতে শেখানো যায়! যায়না হয়তো? কিন্তু বরুণ বিশ্বাস শেখাতে পেরেছেন। তার মৃত্যু দিয়ে শিখিয়ে গেছেন উনি। সেদিনের কামদুনির ধর্ষিতার ভাইয়ের মধ্যে আমি আরেকটি বরুণ বিশ্বাসকে দেখতে পেয়েছিলাম। বরুণের শিক্ষা সঞ্চারিত হবেই। যুগে যুগে আরও অনেক বরুণ বিশ্বাস আসবে। তারাও প্রতিবাদ করবে। তাদেরও চরম পরিণতি হবে মৃত্যুতেই। প্রতিটা বরুণ বিশ্বাসের মৃত্যুর সাথে সাথে জন্ম নেবে আরেকটা বিপ্লব, তৈরি হবে আরেকটা প্রতিবাদের ব্লুপ্রিন্ট।
একটা বরুণকে শেষ করতে যেদিন তৈরি হয়েছিল গোটা একটা কমিটি। তাবড় সব নেতারা যেদিন উঠে পড়ে লেগেছিল একটা বরুণ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে, সেদিনই বরুণ জিতে গিয়েছিলো। বরুণ বিশ্বাসকে আমাদের সবসময় হয়তো মনে পড়বে না, কিন্তু যখনই পড়বে, তখনই বুকে- মাথায় বেড়ে যাবে রক্ত সঞ্চালন। বরুণের শিক্ষা সেখানেই সফল। এক শিক্ষকের মৃত্যু সেখানেই তাকে অমর করে দেয়। আজ মিত্র ইন্সটিটিউশনের দেয়ালে ঝোলানো বরুণ বিশ্বাসের ছবিটা বা রাস্তার তার আবক্ষ প্রতিমূর্তির বা কোন শহিদ ফলকের কোন প্রয়োজন নেই। একটি ছাত্রও যদি আয়নার সামনে দাড়িয়ে বরুণ বিশ্বাসের আবছা প্রতিফলন দেখতে পায়, তবেই আরও হাজার বছর বাঁচবে বরুণ। বরুণের মত শিক্ষক আর চাইনা কিন্তু বরুণের মৃত্যুর বদলে দিয়ে যাওয়া শিক্ষায় শিক্ষিত কোটি কোটি ছাত্র চাই। আজও বরুণ বেঁচে আছে, আজও বরুণ গভীর রাতে বাড়ি ফেরা কোন নারীকে পাহারা দেয় অগোচরে, আজও বরুণ ধর্ষকদের বুক চিরে শেখায় প্রতিবাদের শিক্ষা, প্রতিবাদের ভাষা।
“ আমি ছেলে-হারানো এক গর্বিত মা। আমার ছোটোছেলে বরুণ মৃত্যুভয়ের সামনে দাঁড়িয়েও কখনও পিছু হটেনি। যেদিন পর্যন্ত প্রতিবাদী মঞ্চ সবরকম দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে, সেদিন পর্যন্ত আমার ছেলে অমর থাকবে। বরুণ ছিল, বরুণ আছে, বরুণ থাকবে।’’
—গীতা বিশ্বাস (বরুণ বিশ্বাসের মা) একটি সাক্ষাৎকারে
ফিচার ইমেজ সৌজন্যে- সুমন পোদ্দার via twitter
The vibrant city of Kolkata is set to host an extraordinary musical event as renowned Indian music…
In a heartwarming ode to friendship and the unifying spirit of Pujo, SVF Brands has…
The year 2024 has not been what I had planned so far. Everything went downhill.…
Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…
Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…
This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…
This website uses cookies.