আমি সত্যব্রত, মধ্যবিত্ত কেরানি। আমার জীবনে সব কিছু থেকেও যেন কোথাও একটা দমবন্ধ লাগে। হিসাবের বাইরে বেরিয়ে কিছু পেতে গেলেই কাঁটায় কাঁটায় বিদ্ধ হতে হয়। যেমন, আজ সকাল থেকেই তিন্নি, আমার গিন্নির মাথার ভিতর পুরোনো আগ্নেয়গিরিটা যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, সেটা ঘুম থেকে উঠেই বুঝেছিলাম। বিছানায় চা তো দেয়ই নি, তার উপর ঘুম ভাঙার পর থেকে দেখে যাচ্ছি কাজ করতে করতে এক নাগাড়ে ছেলে-মেয়ে দুটোর সাথে খিটির মিটির করে যাচ্ছে। আজ কালীপুজো, মানে দীপাবলি। মামন, আমার মেয়ের ভাষায় দিওয়ালি। যদিও সেটা আগামীকাল হয় বলেই জানি। যাই হোক, আজ আমি ছুটি পেয়েছি, কালকেও আছে। আমার কাছে ছুটি মানে; সেদিন অফিসের বড় বাবুর বদলে বউ, মানে তিন্নির কপচানি শুনতে হবে।
ফাইলের বদলে বাজারের ব্যাগ বইতে হবে; দুপুরে আলু তরকারি রুটির বদলে ডাল ভাত গিলতে হবে; আর বিকেলে মেজো বাবুর ফরমাইশের বদলে মামনের আবদার মেটাতে হবে। এই শেষের ব্যাপারটা শুনতে ভালো লাগলেও, পকেটে টাকা না থাকলে করতে মোটেও ভালো লাগে না।
এইসব ভাবার সময় যে তিন্নি আমাকে খালি মাঠে একা পেয়ে ওপেন শুটিং করতে শুরু করে দিয়েছে, এবং রীতিমত ধরাশায়ীও করে ফেলেছে, এটা বুঝতে আমার বেশ খানিক্ষণ লাগল। বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিভিন্ন সময়ের ঘটনানুসারে আমি যে কোনো কাজের নয়, সেটা প্রায় প্রমাণ হয়েই এসেছে এই সময় আমি আবিষ্কার করলাম ওপেন ফায়ারিং এর কারণটা। কারণটা রীতিমত সিরিয়াস; বাজার না করলে আজ কিছু রান্না হবে না। পরশু দিনের তিনশো টাকার বাজার নাকি কালকেই শেষ হয়ে গেছে।
আর বেশিক্ষণ সামনে থাকলে, যদি এটা প্রমাণ হয়েই যায় যে আমি কিছু কম্মের নয়, তাই তেঁতো মন নিয়ে তাড়াতাড়ি বাজারটা করতে বেরিয়েই পড়লাম। তিন্নি পই পই করে বলে দিল কোন সব্জিটা কত গ্রাম করে কিনতে হবে।
বাজার করতে বেরিয়ে মনটা আরো তেঁতো হতে শুরু করল। পাড়ার বাজারের পাশেই বেশ অনেকগুলো বাজির দোকান পড়েছে।লোকজনের ভিড়ও বেশ কম নয়। দেখে আমারও ইচ্ছা হল যে মামন আর বিট্টুর জন্যও কিনি কটা ফুলঝুড়ি, রংমশাল, সাপ বাজি। যেমন বাবা আমার জন্য এই দিনটায় নিয়ে আসতো। আমি অপেক্ষা করতাম এই দিনটার। এই একটা মাত্র দিনেই আমি পাশের বাড়ির মন্টু দাদাদের তিন তলা ছাদে ওঠার সুযোগ পেতাম, বাজি পোড়ানোর জন্য। মন্টু দাদাই ডেকে নিত। আমার কাছে সেটা শুধু ছাদে ওঠা ছিল না; ওটাই ছিল চাঁদে পাড়ি দেওয়ার সমান। উপর থেকে দেখা রাত্রি বেলার রঙিন শহরটা আমাকে ভীষণ টানতো। তাই অপেক্ষায় থাকতাম বাবা কখন বাজি আনবে। তারপর আমাদের বাড়ির উঠোনে সেই বাজি শোকাতে দেওয়া, সন্ধ্যেবেলা তুলে রাখা, সে এক বিশাল ব্যাপার ছিল। তারপর কালীপুজোর রাতে মন্টু দাদাদের ছাদ।
এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে তিন্নির বলে দেওয়া সব্জি বাছাই করে দোকানদার-কে ওজন করতে দিয়ে দিয়েছি, সেটা খেয়ালই করিনি। ধাক্কাটা তখন খেলাম যখন দোকানদার দাম বলল দুশো কুড়ি টাকা। আমি আমার বাজারের ব্যাগে ভরা সব্জিগুলোর দিকে তাকালাম; অর্ধেকও ভর্তি হয়নি। অথচ আমার পকেট খালি হওয়ার জোগাড়। চেনা দোকানে ব্যাগ থেকে সব্জি নামিয়ে রাখব; এটা ভাবতেই খারাপ লাগল। আবার দুশো কুড়ি টাকার সব্জি কিনতেও মন সায় দিলো না। কারণ এখনো মাংস কেনা বাকি। আর বাজিই বা কিনবো কি করে মামন-বিট্টুর জন্য? দোকানে ধার রেখে বাজার করার অভ্যাসটাও আমার কোনোদিন নেই। কি করবো বুঝতে না পেরে টাকাটা দিয়েই দিলাম।
আমার মাঝে মাঝে নিজেকে খুব বড় অপদার্থ বলে মনে হয়, এবং আমি এটাও জানি যে আমার ভাবনাটা ভুল নয়। আমার বাবাও তো ক্যানিং জেটিতে টিকিট কাউন্টারে কাজ করত। মায়ের টিউমারের ওষুধ, আমার পড়াশোনা, বাবার পুরোনো দেনা, এত কিছু সামলেও বাবা কিভাবে জানি পিসির বিয়ে, দাদুর অপারেশন সবেতেই টাকা দিত কিছু না কিছু। আমার জন্য নতুন গল্পের বই, ঘুড়ি কেনার টাকা, নতুন জামা, সব বাবার ঘাড় ভেঙেই হত।
অথচ আমি রাইটার্স বিল্ডিঙের সরকারি কেরানি হয়েও বউয়ের আয় করা টাকার উপর নির্ভর করতে হয়। মেয়ের টিউশনির মাস্টারের সাথে টাকার দরাদরি করতে হয়। বর্ষার সময় একটা ইলিশ মাছ কিনলে পরের কত দিন আর মাছ কেনা যাবে না, সেই হিসাবটাও করতে হয়। ছেলে-মেয়ে কে বাজি কিনে দিতে হলে, আজ কতটা মাংস কম কিনতে হবে, সেই হিসাব টাও বাজারে দাঁড়িয়ে করতে হল আমায়।
হিসাব করে যা দাঁড়ালো, তাতে যে পরিমাণ মাংস হবে, তাতে তিন্নি খুশি হবে না; আবার যে পরিমাণ বাজি হবে তাতে দুই ছেলে-মেয়ের কুলাবে না। বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসে বাজি কিনে দিতে গেলেও প্রচণ্ড চাপে পড়তে হবে। কারণ আজ উনিশ তারিখ, সামনে এখনো দশ দিন চালাতে হবে।
তবুও কেন জানি, মামনের বাবাও যে বাজি কিনে আনতে পারে, ছেলে মেয়ের মুখের আনন্দটা উপভোগ করার জন্য, এটা তিন্নির কাছে প্রমাণ করে দেব এই রকম একটা রোখ চেপে গেল মাথায় হঠাৎ করে। তাই মাংসর দোকানে গিয়ে মাংস কিনে নির্লিপ্তভাবে বলে দিলাম, আজ টাকা আনতে ভুলে গেছি, কাল দিয়ে দেব। তারপর বাকি টাকা দিয়ে বাজি কিনে যখন বাড়ী ফিরলাম তখন শুনলাম তিন্নি মেয়ে কে বলছে “তুই কি ভুলে গেলি গত বছর তোর বাবার পিসি মারা গেল? সেই জন্যই এই বছর তোদের বাজি পোড়াতে পারবি না।”
আমার নিজেকে কালা মনে হল। আমি যেন শুনলাম তিন্নি বলছে “তুই কি ভুলে গেলি তোর বাবা কেরানি? সেই জন্যই তোরা কোনোদিন আনন্দ করতে পারবি না।”