সবার মনের ভাবনাগুলো দিন দিন হয়ে উঠছে বিচিত্র, খানিকটা অবৈধের রঙ ধরছে তাতে।
“হচ্ছে না, হচ্ছে না! একটা সিনও ঠিকঠাক হচ্ছে না! অর্ণা তুমি কি আজ ডিস্টার্বড? তাহলে বলো, আজ এখানেই প্যাকআপ করতে বলছি।” কথাগুলো এক নিমেষে বলে গেলেন বাঙালি ডিরেক্টর সপ্তর্ষি বিশ্বাস। কথা গুলো যাকে বলা হল তিনি হলেন অপর্ণা চ্যাটার্জী। টলিউডের মোস্ট পপুলার অ্যাকট্রেস। তবে মায়াবী আলোর জগতে এসব নাম এখন আর চলে না। তাই পোশাকি নাম নিতে হয়েছে, মাঝের ‘প’ – কে ছুটি দিয়ে অর্ণা। এরকম আর যা কিছু নিজের ক্যারিয়ারের জন্য বাধা বলে মনে করেছে, সে সব কিছুই পিছনে ফেলে এসেছে। সব কিছু। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের অর্ণা বর্তমানে টপ মডেল হিসেবেও কাজ করেন দাপিয়ে। রূপে যে তিনিই সেরা সেটা বলা চলে না, তবে গুণে তিনি ‘একমেব অদ্বিতীয়ম্’। অভিনয়ে তুখোড়। নায়কের সঙ্গে একটা ইন্টিমেট সিনের শুটিং চলছে। নায়ক নায়িকার কোমড়টা শক্ত করে চেপে ধরবে, আর নায়িকা নায়কের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরবে। তার পর ওষ্ঠাধরের দুর্দম আলোড়ন। ঘরের সাদা আলো নীলচে হয়ে মায়া সৃষ্টি করে মিলিয়ে যাবে। নায়কের এটাই প্রথম বড়ো কাজ। এর আগে কয়েকটা মেগা সিরিয়ালে লিড রোল করেছে। সে আজ প্রতিটা শট্ পারফেক্ট দিচ্ছে। শুধু ভেস্তে যাচ্ছে অর্ণার জন্য। লিপলক কিসের সিনে সেই ফিলিংস টা তেমন নেই। ডিরেক্টরের কথায় অর্ণা বলল,“না থাক। আরেকটা ফাইনাল শট্ হোক।” নায়ক জুনিয়র অ্যাক্টর, তাই মুখের ওপর না করতে পারল না।
লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন— এক হাতে রহিতের গলা জড়িয়ে আরেক হাতে মাথার পিছনে, চুলে আঙুল নিয়ে উত্তাল খেলায় মেতেছে নায়িকা। সশব্দ চুম্বন দৃশ্য সবাই যেন খানিকটা উপভোগই করল। কি ফিলিংস! রোহিতের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। যা ম্রিয়মাণ, তা বুঝি কঠিন হল। পরক্ষনেই তরল। তবে অর্ণা অভিনয়টুকুই করল, ওর শরীরে-মনে কোনো প্রভাব পড়েনি। সপ্তর্ষি হাততালি দিয়ে বলে উঠলো,“ব্র্যাভো! ব্র্যাভো! এক্সিলেন্ট অর্ণা! হোয়াট আ এক্সপ্রেশন ডিয়ার!” অর্ণা মৃদু হেসে হ্যান্ডশেক করলো। মুখে কিছু বলল না।
রোহিত দাশগুপ্ত। উচ্চতা – ৬ফুট ২ইঞ্চি, গায়ের রঙ চাপা ফর্সা, বুকে— হাতে সুকুশলী মাংসপেশীর বাহার। এক কথায় নায়কোচিত গঠন। অর্ণার থেকে বয়সে প্রায় ৩-৪ বছরের ছোটো। এই রোহিত দাশগুপ্তই অর্ণার বিপরীতে নয়কের অভিনয় করছে। রোহিত অর্ণার কাছে এসে বলল, “আপনার অ্যাক্টিং এর ফ্যান আগে থেকেই , তবে আজ…আজ… কী করে বলব ঠিক…” কথা গুলো শেষ করার আগেই অর্ণা শুরু করল,“রোহিত, তোমাকে আর কতবার বলবো আমাকে আপনি আপনি করবে না । আর কি যেন বলছিলে, আজকের অ্যাক্টিং! কেনো তোমার আপত্তি ছিল নাকি?” রোহিত একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, ইঙ্গিতে জানালো আপত্তি তার ছিল না। বরং মুখের চওড়া হাসি অন্য কথা বলছে। এত স্মার্ট একটা ছেলে, মেয়েদের সাথে ডেটিং, লেট নাইট পার্টিতে চকোবয়, যে কিনা সিনেমার নায়ক সেও যেন ক্যাবলা হয়ে যায় অর্ণার সামনে। আসলে এটার কৃতিত্ব অর্ণার নিজের। ওর হাসি খুশি মিশুকে স্বভাবের নরম চাদরের ভিতর ব্যক্তিত্বের কঠিন একটা আবরণ আছে। যা সহজে কেউ ভেদ করতে পারে না।
বাড়ি ফিরে ফ্রেস হল। ইতস্তত ভাবে ফোনটা বারবার হাতে নিচ্ছে, আর রেখে দিচ্ছে। সাহস করে কল করেই ফেললো। রিং হচ্ছে। অর্ণার বুকের ভিতরে তোলপাড় করে যাচ্ছে চেনা ঝড়ের পূর্বাভাস। যেবার ও সব কিছু এক নিমেষে শেষ করে এসেছিল— মেয়েটা তখন মাত্র দেড়বছর। কে জানে এখন সে কত বড় হল! কেমন দেখতে হয়েছে তাকে! ওর মতো নাকি অঞ্জনের মতো! বারবার রিং হয়ে কল কেটে যাচ্ছে। রিসিভ করছে না। ফোনটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে কেঁদে ফেললো অর্ণা। এত দিন পর কি মাতৃত্ব জেগে উঠলো তবে?
ফোন বাজছে। ফোনের ওপারে সেই চেনা কণ্ঠস্বর— “হ্যালো, কে বলছেন? হ্যালো!…” কলেজের প্রথম প্রেম— সাত বছরের সম্পর্ক— বিয়ে— সন্তান। তারপর ঊর্ধ্বমুখী সুখী সংসারটা হঠাৎ শেষ হয়ে গেল, গভীর খাত। অর্ণা স্থবির। বিরিক্ত হয়ে অঞ্জন ফোনটা কেটে দিতেই যাচ্ছিল; ঠিক সেই সময় খুব অবাক হল, অর্ণার বোল ফুটলো
— কেমন আছো?
— কে?
— চিনতে পারছো না?
— অনেক চিনেছি। আর না। কেনো কল করেছেন মিস চ্যাটার্জী?
— তুই থেকে আপনি!
— আপনার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই।
— মুনাই কেমন আছে? অনেক বড়ো হয়ে গেছে না!
অঞ্জন ফোন কেটে দিল। রাগে-ঘৃণায় গা রি রি করছে। অপর্ণা কেন ফোন করলো! কী চায় ও! সবই তো শেষ করে দিয়ে গেছে। দুধের শিশুকে ফেলে মডেল হতে গেলো; অভিনেত্রী অর্ণা চ্যাটার্জী আবার কী অভিনয় শুরু করল?
অঞ্জন ও অর্ণার প্রেম শুরু কলেজের ক্লাস রুমে,
এক ক্লাস, এক ডিপার্টমেন্ট। এমনকি ওদের স্পেশাল পেপারও ছিল প্রায় একই। মনের মিল ছিল বরাবর। এক্কেবারে রোমিও-জুলিয়েট। তখনও অপর্ণা অপর্ণাই ছিল। তবে একটা বিষয়েই অঞ্জনের একটু আপত্তি ছিল— অপর্ণার মডেলিং করা নিয়ে। মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে অপর্ণা। বাবা-মাও কোনো দিন চায়নি মেয়ে মডেলিং, অভিনয় এসব করুক। পাড়ার মঞ্চে নাটক পর্যন্তই ঠিক আছে। কিন্তু অপর্ণা ছোটো থেকেই সপ্ন দেখেছে সে খুব নামকরা অভিনেত্রী হবে— কত সুখ্যাতি— কত মানুষের ভালোবাসা— আর সবচেয়ে বড় নিজের পরিচয়। কলেজ জীবন থেকে মানে অঞ্জনের সঙ্গে যখন জমিয়ে প্রেম করছে তখন থেকেই অপর্ণা দু’-একটা বিউটি কনটেস্টে অংশগ্রহণ করেছিল। প্রতিবারই বিফল হয়েছে। অঞ্জন তাতে খুশিই হতো। অঞ্জনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল অপর্ণা কোনোদিনই এই রঙচঙে জগতে সুযোগ পাবে না। শ্যামলা বরণ কৃষ্ণকলি তারই থাকবে। তবে অঞ্জন কোনোদিন অপর্ণার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি। যেদিন দেড় বছরের মুনাইকে রেখে বাড়ি ছাড়লো সেদিনও না। অপর্ণা চলে যাওয়ার পর ওর দেওয়া মেয়ের নামটাও অঞ্জন বদলে ফেলেছিল। যাকে চরম ভালোবাসতো সেই ঘটনার পর তাকেই এখন সব থেকে বেশি ঘৃনা করে। এটাই হয়তো স্বাভাবিক।
ক্রমশ…
–অর্যমা