বৈধতার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সম্পর্কগুলো কখন যে অবৈধ গলির মুখে বাঁক নেয় কেউ বলতে পারে না। সময় যে মানুষকে কোন পথে চালিত করে সে সবই অদৃষ্টের হাতে। এমনই এক অদৃষ্টের পরিহাসে বদলে গেল রাতুল-নয়নার জীবন।
কথায় বলে ‘অতিতেই ক্ষতি’— রাতুল-নয়নার অতিরিক্ত উল্লাস, বাঁধ ভাঙা আনন্দের ঢেউই ওদের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ালো। পাহাড়ী পথে মুখিয়ে ছিল মৃত্যু। পাথর বোঝাই লরির মুখোমুখি হতেই সব শেষ।
তিন দিন পর নয়না যখন চোখ খুললো তখন সে হসপিটালের বেডে শুয়ে। কপালে ব্যান্ডেজ, মাথাটা ঝিমঝিম করছে, চারিদিক যেন ধোঁয়ার মতো আবছা। পায়েও বেশ ভালো রকমের চোট। পাশে একজন নার্স ছাড়া আর কেউ নেই। কীভাবে হসপিটালে এলো, কী ঘটেছিল কিছুই বুঝতে পারছে না। নিজের নামটাও মনে করতে পারছে না। নাকি সে মনে করতে চাইছে না!
অ্যাকসিডেন্টের পর রাতুলের খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুলিশ অনুমান করছে লরির সঙ্গে ধাক্কায় বাইক সহ রাতুল খাদে পড়ে গেছে। নয়না কোনো ভাবে রাস্তার দিকে ছিটকে পড়েছিল, তাই প্রাণে বেঁচেছে। তবে পা ও মাথার ক্ষত গুরুতর। পুলিশ এখনো রাতুলের খোঁজ খবর চালাচ্ছে, তবে এই ধরনের কেসের কোনো সুরাহা হয় না। এমন কত কত ফাইল রোজ রোজ জমা পড়ে। পাহাড়ী রাস্তায় ক্যালমা দেখিয়ে ড্রাইভ করতে গিয়ে হামেশাই ব্যাচেলর ছেলের দল তলিয়ে যায় গভীর খাতে, কখনো কখনো পুরো পরিবারটাই শেষ হয়ে যায়। নয়নার পরমায়ু আছে, তাই এ যাত্রায় বেঁচে ফিরেছে। এই ফাইলটিতেও ধুলো পড়বে। সাধারণ অ্যাকসিডেন্ট কেস বলে সমাধানও হয়ে যাবে। রাতুল আর ফিরে আসার নয়, সে আর ফিরবে না।
রাতুল-নয়না তো কয়েনের একটা পিঠ, আরেক পিঠে রয়েছেন মীনা দেবী ও দীনেশ বাবু। তিন দিনে সেই পিঠেও সবকিছু তোলপাড় হয়ে গেছে। ছেলে বৌমা নিখোঁজ শুনে মীনা দেবী শয্যা নিয়েছেন। স্ট্রোক। লোয়ার পার্ট একেবারে অকেজো হয়ে গেছে। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন উনি আর হাঁটা চলা করতে পারবেন না। শুধু মনের জোরে দীনেশ বাবু শক্ত হাতে পরিস্থিতির সামাল দিচ্ছেন। ‘ছেলেদের কাঁদতে নেই, ভেঙে পড়তে নেই’— ছোটো থেকে শুনে আসা এই কথা গুলোই বুঝি ষাট ছুঁই ছুঁই মানুষটিকে এখনো মনোবল যোগাচ্ছে। ভগবানের ওপর ভরসা রেখে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করছে বাঁচার শেষ অবলম্বন টুকু বাঁচাতে।
মীনা দেবীকে ইমারজেন্সি ওয়ার্ড থেকে রিলিস করে জেনারেল ওয়ার্ডে দেওয়া হয়েছে। যখন তখন পেসেন্টের সঙ্গে দেখা করার নিয়ম নেই। দীনেশ বাবু বসে রয়েছেন ওয়েটিং রুমে, দেখা করে আবার পুলিশ স্টেশন যেতে হবে। তিন দিন ধরে মানুষটার না হয়েছে ঠিক মত খাওয়া, না হয়েছে ঘুম। প্রাণবন্ত দুটি ছেলেমেয়ে অচেনা অজানা জায়গায় বেড়াতে এসে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেল, স্ত্রী মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে— এহেন পরিস্থিতিতে দীনেশ বাবুর মানসিক অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করার থেকে এভারেস্ট জয় করা সহজ। এদিকে পকেটের দম শেষ। ব্যাংকে যা আছে, আসতে আসতে তাও নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। কী ভাবে কার্ডে পেমেন্ট করতে হয়, ছেলে অনেকবার শেখাতে চেয়েছিল; কোনোদিন দরকার হয়নি বলে দীনেশ বাবুই শেখার চেষ্টা করেননি। উনি ওয়েটিং রুমের নরম সোফায় বসে যখন এসব সাত পাঁচ চিন্তা করছিলেন ঠিক তখনই ঘরের চার কোণে লাগানো ছোটো স্পিকার থেকে ভেসে এলো— “ মিস্টার দীনেশ সেন মিট অ্যাট দ্যা রিসেপশন ইমিডিয়েটলি” অনাউন্স শুনে ওনার হার্টবিট যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল, মীনার বাড়াবাড়ি কিছু হল না তো!
হন্তদন্ত হয়ে রিসেপশনে গিয়ে দেখেন দুজন পুলিশ অফিসার ওনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। একজন স্থানীয় থানার অফিসার, আগের দিন রিপোর্ট লেখাতে গিয়ে পরিচয় হয়েছে। আরেকজন অচেনা। অপরিচিত পুলিশটি নয়নার ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,“চেনেন?”
– হ্যাঁ, এই তো আমার পুত্রবধূ, নয়না সেন। ওর মাথায় ব্যান্ডেজ! আর আমার ছেলে কই? রাতুল!
– ওনার বডি পাওয়া যায়নি।
– বডি! মানে!
– মানে ওকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, আমরা অনুমান করছি বাইক নিয়ে খাদে… ভেরি সরি মিঃ সেন
দীনেশ বাবু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখ দুটো সজোরে বুজে নিয়ে শুধু মাথা নাড়লেন বার কয়েক। চোখের কোণে জল এলেও ঝরে পড়তে দিলেন না, তার আগেই দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– আর নয়না?
– এই ছবির মেয়েটিই যদি নয়না সেন হয়, তবে উনি বেঁচে আছেন। অবস্থা ক্রিটিক্যাল। ওনার স্মৃতি হারিয়ে গেছে, নিজের নামটাও বলতে পারছেন না। আমরা মিসিং ডাইরি আর হসপিটালের রিপোর্ট মিলিয়ে অনুমান করে আপনার কাছে এসেছি।
– কোন হসপিটালে আছে?
– মেঘালয় সেবাশ্রম হসপিটাল।
– আমাকে একটু পৌঁছে দেবেন?
– সিওর
মীনা দেবীর জ্ঞান ফিরেছে, দীনেশ বাবুকে দেখে প্রথম যে নামটা নিলেন, সেটি— রাতুল। দীনেশ বাবু মীনা দেবীর অলক্ষে চোখ মুছলেন। “মীনা তুমি বিশ্রাম নাও, সব ঠিক আছে।” দীনেশ বাবুর কথাগুলো শুনে মীনা দেবী আরো প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু নার্স এসে ওষুধ খাওয়ানোর বাহানায় ওনাকে থামিয়ে দিল—“ভিজিটিং আওয়ার ওভার।” দীনেশ বাবু মীনা দেবীর মাথায় হাত বুলিয়ে সমস্ত কষ্ট বুকে চেপে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
মেঘালয় সেবাশ্রম হসপিটালে পৌঁছে সব হারানো মানুষটা আবার কিছু কুড়িয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখছিল। নয়নাকে দেখে দীনেশ বাবুর বুকের ভিতরে হাতুড়ি মারার যন্ত্রণা অনুভব হল। একমুখ হাসি নিয়ে যে মেয়েটা হাত নেড়ে টাটা করেছিল তার একি অবস্থা! আর রাতুল, সেই বা কোন না ফেরার দেশে! পর পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নয়নার কাছে গিয়ে বসলেন দীনেশ বাবু।
– মা, আমাকে চিনতে পারছিস?
– আপনি কে?
– আমি, আমি তোর বাবা! রাতুল… মনে পড়ছে না তোর?
– রাতুল! রাতুল কে?
ডাক্তার বাবু এসে জানালেন,
– ওনার সামান্য একটা ব্রেইন হ্যামারেজ হয়েছে, অ্যাক্সিডেন্টের আগের কিছু আর মনে নেই। কোনো কিছু মনে করানোর জন্য জোর করবেন না। এতে আরও ক্ষতি হতে পারে।
– আরও ক্ষতি! আর কোনো ক্ষতি বাকি নেই ডাক্তার বাবু…
দীনেশ বাবু নয়নার কাছে বসে ওর হাত দুটো ধরে বললেন,“তুই আমার মেয়ে, প্রাপ্তি।” নয়নার আজ পুনর্জন্ম হল, নতুন পরিচয় হল, সে আর নয়না নয়, প্রাপ্তি সেন। সে আজ থেকে দীনেশ বাবুর পুত্রবধূ নয়, দীনেশ বাবুর মেয়ের পরিচয়ে বাঁচবে।
ক্রমশ…
– অর্যমা