আনন্দ তো আর বৈধ অবৈধের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকে না, সেটা যে কতক্ষন থাকে, কী ভাবে থাকে সেটা বোধ হয় ঈশ্বরই জানেন। কখনো কখনো অবৈধতার মধ্যে সুখ থাকে, আর বৈধ আচরণ কষ্ট দেয়। তা না হলে কি ওদের জীবনটা এভাবে এলোমেলো হয়ে যায়! এমন ভাবনাটা মীনা দেবীর। রাতুলের বিদেশে রিসার্চ করার সুযোগ এসেছে, চিঠিটা হাতে এলো ঠিক বেড়াতে যাওয়ার আগের দিন। এতে তো মা হিসাবে ওনার খুশি হওয়ার কথা, গর্বিত হওয়ার কথা। কিন্তু একমাত্র ছেলে অতো দূর চলে যাবে, তাও আবার পাঁচ বছরের জন্য— এটা উনি ঠিক মানতে পারলেন না। আসলে অনেক ঠাকুরের কাছে মানত করে বিয়ের বারো বছর পর রাতুল হয়েছিল। মীনা দেবী একটি দিনের জন্য চোখ আড়াল করেননি ছেলেকে। যেবার রাতুল কলেজ থেকে পাঁচ দিনের জন্য এক্সকার্সনে গিয়েছিল, ছেলেকে দেখতে না পেয়ে সেবার তো ওনার জ্বর ফুটে গিয়েছিল। একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট অসম্পূর্ণ রেখেই মায়ের কাছে ফিরে এসেছিল রাতুল, কাজটা খানিকটা অবৈধ জেনেও কলেজের নিয়ম ভেঙে ফিরতে বাধ্য হয়েছিল সে। নয়নারও মনটা বেশ ভার, তবে সে রাতুলকে আটকাতে চায় না। সে চায় তার রাতুল জগৎ খ্যাত বিজ্ঞানী হোক। দীনেশ বাবুর ছেলেকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হলেও তিনি নিজেদের স্বার্থে ছেলের প্রতিভা কিংবা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কোনোটাই নষ্ট করতে চাননা। বাধা শুধু মা, মায়া।
সাময়িক বিচ্ছেদের আগে একরাশ খুশি ও আনন্দের স্মৃতি ধরে রাখতে চায় সকলেই। যাতে দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর কেটে যায়। যদিও মীনা দেবী তখনও পুরো সত্যিটা জানেন না, উনি জানেন রাতুল বিদেশ যাচ্ছে না। পরের দিন ওদের শিলং যাওয়ার টিকিট। গুয়াহাটি এক্সপ্রেসে রওনা শুরু। হর্ষ-বিষাদ মাখা এক নতুন যাত্রা। রাতুল ও নয়না ঠিক করেছে মাকে যে করেই হোক রাজি করাবে। ওদের বাবাও সমানতালে চেষ্টা করছে।
ট্রেনে যেতে যেতে কত গল্প, হাসি, ঠাট্টা— খুশির রঙিন মুহূর্তগুলি মুঠোফোনে ফ্রেম বন্দি হচ্ছে বারংবার। গুয়াহাটি স্টেশন থেকে গাড়ি করে সোজা হোটেল। সেই দিন বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন সকাল থেকে স্পট ঘুরে দেখা শুরু হবে। রাতুল-নয়নার সেই ক্লান্তি ভরা রাতটাই হালকা ঠান্ডার আমেজে বেশ মায়াবী হয়ে উঠল। তাতে মদত যোগালো ঝমঝমে ভারী বৃষ্টি। লালচে আভা ঘরের সাদা মসৃন দেওয়ালে যেন প্রেমের আঁকিবুঁকি কেটে যাচ্ছে। যে মেয়েটা কোনোদিন কারো কাছে কিচ্ছুটি চায়নি, সেই নয়ন আবদারের সুরে রাতুলের কাছে তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটিই চেয়ে বসলো, ছোট্ট রাতুল। রাতুল ভালোবেসে নয়নাকে নয়ন বলে ডাকে। রাতুল বিদেশ যাওয়ার আগে নয়ন একটি অবলম্বন চায়, নয়ন তার নয়নের মণিকে চায়, বিচ্ছেদের কষ্টটা ভুলতে নিজেকে জড়িয়ে নিতে চায় মাতৃত্বের মোড়কে। কিন্তু রাতুল দায়িত্বের ভার বাড়িয়ে যেতে চায় না। নতুন স্বপ্ন দুচোখে মেখে সে যতই মুক্তি খুঁজছে, ততই যেন মায়ার জালে আটকা পড়ে যাচ্ছে।
পরের দিন সকাল সকাল ট্যুর গাইড গাড়ি নিয়ে হাজির। আগের রাতে ভারী বৃষ্টি হওয়ায় ওয়েদার একদম ঝকমকে রৌদ্রোজ্জ্বল, নাহলে অনেক সময় সকালের দিকে প্রকৃতি কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে থাকে। এতো দূর দূরান্ত থেকে এসে মানুষজন রহস্যময় সাদা কুয়াশায় পাহাড়ের আসল রূপটাই দেখতে পায় না। কিন্তু, ওদের কপাল ভালো। রং তুলিতে আঁকা ছবির মতোই স্পষ্ট করে প্রকৃতিকে দুচোখ দিয়ে দেখতে পেলো। জাফলং জিরো পয়েন্ট দিয়েই শুরু করলো। ঝুলন্ত সেতু, নীচে সবুজ জল, চারিদিক পাহাড়ে ঘেরা— সে যে কি রূপ! তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কখনো কখনো প্রকৃতি বাঁধা পড়লো সাড়ে ছয় ইঞ্চির দামি মোবাইল ফোনে। আবার গাড়ি ছুটলো পাহাড়ি রাস্তায়। পাহাড়ের গায়ে সবুজের দুর্ভেদ্য বুনট, তার ওপর হদুল রোদ যেন সোনার মতো ঝিলিক মারছে। এমন মনোরম পরিবেশেও কারো কারো যেন মন খারাপ। জানালার কাঁচ নামিয়ে মীনা দেবী বললেন—
– আচ্ছা বাবু, তুই ওদের জানিয়ে দিয়েছিস তো?
– কাদের কী জানাবো মা?
– এই যে তুই বিদেশ যাচ্ছিস না! তুই কিন্তু ওদের সাফ সাফ জানিয়ে দে, তুই দেশে ঘরে থেকেই রিসার্চ করবি।
– মা! এখন এসব কথা থাক না, ঘুরতে বেড়াতে এসে আনন্দ করো তো!
– না, থাকবে কেনো? তুই যখন যাচ্ছিস না ওদের জানিয়ে দিতে আপত্তি কোথায়?
– আচ্ছা, জানিয়ে দেবো খন।
নয়না মুখ ঘুরিয়ে চোখে ধুলো পড়ার অছিলায় চোখের জল মুছলো। দীনেশ বাবুর হাসিটাও কেমন যেন ফিকে হয়ে গেল।
কথায়-কান্নায়-আবেগে ভাসতে ভাসতে কখন যে এতটা পথ চলে এলো! গাড়ি এসে থামলো অপরূপ একটি জায়গায়। সবুজ পাহাড়ের গা বেয়ে যেন রূপো গলে গলে পড়ছে। একটা নয়, পর পর সাতটি ঝর্ণা— শান্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে দিচ্ছে ঝর্ণার শব্দ। জায়গাটি শিলংয়ের অন্যতম জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট— সেভেন সিস্টার ফলস্। আবার মুগ্ধতা। রাতুল যখন একটা রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে ঝর্ণার দিকে একমনে চেয়ে ছিল, ঠিক তখনই এলোমেলো চিন্তারা সব সাদা ফেনার মতো ধেয়ে এলো, ওকে ঘিরে ধরলো একরাশ মনখারাপ। ঝর্ণার শব্দে যেন মা-বাবা-স্ত্রীর কান্নার শব্দ শুনতে পেলো। নয়না কখন ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি সে।
রাতুলের হাতে হাত রেখে নয়নাই প্রথম শুরু করল—
– কী ভাবছো?
– কিছু না তো!
– কথা ঘুরিও না, ওটা তুমি একদম পারো না। বলো কী ভাবছো?
– আমি চলে গেলে তোমরা খুব কষ্ট পাবে বলো!
– বলতে হবে!
– কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না, এটা আমার বহুদিনের স্বপ্ন নয়ন!
– আটকাইনি তো!
– কিন্তু আমি বুঝতে পারছি তোমরা কেউ আমায় যেতে দিতে চাও না।
– তবে যাচ্ছো কেনো!
নয়না কথাটা বলেই কেঁদে ফেললো। নিজেকে তিল তিল করে যেটুকু শক্ত করেছিল, রাতুলের কথায় আর সামলাতে পারল না, নিমেষে গলে গেল। রাতুল বুঝলো তার বিদেশ যাওয়ার যতটুকু সম্ভবনা ছিল ধীরে ধীরে সেটাও কমে আসছে।
ড্রাইভার দাদার ডাক পড়লো। এরপর নাকি আরো সুন্দর একটা জায়গা ঘুরিয়ে দেখাবে। নাম জানতে চাওয়ায় কী একটা বললো, মোদ্দা কথা ওখান থেকে ভারত ও বাংলাদেশের বর্ডার দেখা যায়। যদিও প্রকৃতি তার নিজের চলনে চলেছে, সে কোনো দেশের চোখ রাঙানি সয়নি। আর একদিকে মৃদু স্রোতে বয়ে চলেছে কোনো এক নাম না জানা সরু জলস্রোত। ওরা ওই জায়গায় পৌঁছে দেখলো ড্রাইভার দাদা একটুও অত্যুক্তি করেননি। সত্যিই প্রকৃতি যেন তার সম্পূর্ণ শোভা মেলে ধরেছে এখানে। দীনেশ বাবু ও রাতুল বর্ডারের দিকে তাকিয়ে দেশ ভাগের জন্য আক্ষেপ করে ইতিহাস চর্চায় ব্যস্ত। দীনেশ বাবুর হঠাৎ কী যেন মনে পড়লো, মুখটা একেবারে ম্লান হয়ে গেল। রাতুল বাবার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল—
– কী হল বাবা?
– কদিন পর তুইও তো বহুদূর চলে যাবি খোকা, সেই কোন বিদেশ বিভূঁই! এখন যদিও ফোনে ফোনে ভিডিও কল হয়, তোকে ফোনের ওপারে দেখতে পাবো কিন্তু চাইলেও ছুঁতে পারবো না!
দীনেশ বাবুর চোখের কোণে জল। রাতুল কী বলবে কথা পেলো না। রাতুলের পকেটে ফোন বাজছে। নয়না কল করছে। ফোনটা তুলতেই
– রাতুল, তাড়াতাড়ি এসো! মায়ের খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে!
– ইনহেলার দিয়েছো?
– ওটা তো বাবার পকেটে। তোমরা তাড়াতাড়ি এসো।
আর কথা না বাড়িয়ে বাপ-ছেলে তাড়াতাড়ি মীনা দেবীর কাছে গেল। ইনহেলার নিয়ে মীনা দেবী একটু সুস্থ হলে সেদিন হোটেলে ফিরতে হল। ফেরার পথেও মায়ের একই কথা— “বাবু তুই ওদের বারণ করেছিস তো? তুই চলে গেলে কিন্তু আমি…”
ক্রমশ…
– অর্যমা