নীল টিক
পর্ব- ৩
মেসেজটার পাশে সময় বলছে ১০টা বেজে ১৫ মিনিট৷ আগেআগেই ইন্টারভিউয়ের জন্য পৌঁছে গেলাম৷ শরীরে আজ যেন এক নতুন আত্মবিশ্বাস অনুভব করলাম৷ সেই আত্মবিশ্বাসের দরুণ চাকরিটা আমার কনফার্ম হয়ে গেল৷ আমিই পৃথিবীর সবচেয়ে খুশী মানুষ, কাল রাতে জীবনটা শেষ হয়ে গেলে জীবনের নতুন এই সুধারস আর পানই করতে পারতাম না হয়তো৷ প্রিয়াই হয়তো ওর আত্মবিশ্বাস আমার মধ্যে সঞ্চার করেছে৷ তৎক্ষণাৎ মাকে ফোন করে জানালাম চাকরির খবরটা৷
মন বলে উঠল প্রিয়ার জন্যই এই নতুন জীবন তাই আর মেসেজ নয়, ধন্যবাদ জানানোর জন্য ছুটে গেলাম প্রিয়ার সেই পাইকপাড়ার বাড়িতে৷ ইলেভেন-টুয়েলভে অনেকবার ওই বাড়ির আশপাশ দিয়ে গেছি ওর দেখা পাওয়ার জন্য৷ সেই চেনা পথই আজ নিয়ে গেল ওর বাড়ির সামনে, কিন্তু বাড়িতে তালা৷ পাশের বাড়ির একজন ভদ্রলোক সাইকেল নিয়ে বেরোচ্ছিলেন তাঁকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওরা সবাই ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হসপিটালে, আর কিছু না শুনেই ছুটলাম ঠাকুরপুকুর, হঠাৎ মনের ভেতরে আশঙ্কার কালো মেঘ ছেয়ে গেল৷ ওর সাথে দেখা করার এক জেদ যেন বাসা বেধেঁছে আজ৷ হোয়াটসঅ্যাপ খুলে দেখলাম ওকে পাঠানো শেষ মেসেজটা এখনও নীল টিকে পরিণত হয়নি৷
হসপিটালে পৌঁছেই গ্রাউন্ড ফ্লোরে কোরিডর বরাবর চোখে পড়ল এক ভদ্রলোক দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ চিনতে একদম ভুল হল না সেই ইলেভেন-টুয়েলভে কোচিং-এর শেষে স্কুটার নিয়ে ওকে আনতে আসত, প্রিয়ার বাবা৷ এনার দিকে কিছুটা এগোতেই গোঙানির শব্দ আমার কানে ভেসে এল, কিছু মানুষের চোখে মুখে বিলাপের ছাপ, সামনে এগিয়ে রুমের দরজা খুলতেই দেখলাম বিছানায় শুয়ে আছে মাথায় চুলহীন এক শীর্ণকায় নিথর দেহ৷ মনের ভেতর থেকে কেউ একজন তারস্বরে চিৎকার করে বলল এই তো আমার প্রিয়া, তোর সাথে দেখা করার জেদটা পূরণ হল কিন্তু তোকে না বলা কথাগুলো চাপা পড়ে গেল হৃদয়ভাঙনের ভূমিকম্পে৷
পিছন ফিরে আর তাকাইনি, বাড়িও আর ঢুকিনি, একা আনমনে হোয়াটসঅ্যাপে ওর ইনবক্সটা খুলে মোবাইলটাকে হাতে নিয়ে বসে আছি কুটিঘাটের জেটিঘাটের এক কোণায়৷
সূর্যাস্তের আলো আগুন লাগিয়েছে নদীর বুকে, দেখছি আর ভাবছি প্রিয়া আমাকে আজ আমার জন্মদিনে এক নতুন জন্মের ঠিকানা দেখিয়ে দিয়ে নিজেই হারিয়ে গেল মরণের ওপারে৷
অন্ধকারে একটা দেশলাই কাঠি জ্বলে উঠে যে আলোকিত করেছিল তা ভালেবাসার প্রদীপটাকে জ্বালানোর আগেই আবার নিভে গেল৷
বিবেক গর্জে উঠে বলল ওর দেওয়া এই ‘নতুন জীবনকে’ সূর্যাস্তের ন্যায় নদীর ওপারে ডুবে যেতে দেব না আর…
সময়ের কাঁটার সাথে পা মিলিয়ে সূর্য ডুবে চাঁদের আলো লুটোপুটি খাচ্ছে গঙ্গার বুকে, তখনো ‘ওর’ ইনবক্সটার দিকে তাকিয়ে বসে আছি এক অজানা আগ্রহে যদি শেষ মেসেজের পাশের ওই দুটো টিক হঠাৎ ”নীল টিক”-এ পরিণত হয়৷