রোদ-জ্যাকেট (প্রেমিকের উত্তর)

প্রিয় লাবণ্য,

”আবার সেই শীতকাল, রোদেভেজা ছাদ, ছুটির বাতাস, দুই পায়রার আলাপ, আধখোলা হৃদয়ের জানলার কাঁচ, শুধু তোকে দেখার অভিলাষ
প্রথম প্রেমের পেয়েছিলাম আভাস, তাই এক অজানা পাগলামোই ছিল আমার রোজকার কাজ…”

এত বছর পর ভাঙা লেটার বক্সটায় গোলাপি খামে তোর চিঠিটা দেখে স্মৃতিপটে ভেসে এল সেই দিনটা, আরে সেই যেদিন আমার প্রথম চিঠিটা বাড়ির কাজের মাসিকে দিয়ে তোর বাড়ি পাঠাতে গিয়ে তোর কাকা ধরে ফেলেছিল!
তারপর থেকে নামও আর লিখতাম না চিঠিতে শুধু ‘খামের রঙে থাকতো ইঙ্গিত’; তোর গোলাপি আর আমার খয়েরি৷ শীতের রোদকে জ্যাকেট করে বাবার কিনে দেওয়া বাইনোকুলার দিয়ে চিলেকোঠার ঘরটার জানলা দিয়ে প্রায় রোজই তোর ছাদে চোখ সাজাতাম এক অজানা উন্মাদনায়৷ এখন চোখের পাওয়ারটাও বেশ বেড়েছে হয়তো উন্মাদনার অভাবে৷ সেই ঘুড়িতে চিঠি লিখে তোর ছাদে ঘুড়ি ফেলে সুতো ছিঁড়ে দেওয়া, স্কুল থেকে ফিরে কোনোরকমে স্কুলড্রেস ছেড়ে ছুটে যাওয়া বাসস্ট্যান্ডে, তোর স্কুল বাসের আশায়৷ তোর সাথে দেখা করার আগ্রহরা প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় মনের ঘড়িতে আওয়াজ দিতো৷
তোর লাল পেড়ে শাড়ি, বেণী করা চুলে লাল ফিতে আমার চোখকে চুম্বকের মত আর্কষণ করত৷ গলিটার দুপাশে আমরা সমান্তরালে হাঁটতাম যাতে কেউ না বুঝতে পারে, ইশারারা খেলা করতো আমাদের চোখে চোখে তখন৷

তারপর টেনে ওঠার পর আমাদের সব কোচিং-ই প্রায় এক ছিল৷ তখন আমরা একে অপরের বুকে ভবিষ্যতের মানচিত্র আঁকছি৷ প্রেম নামক চিনিবিহীন বন্ধুত্বের গ্লাসে ভালোবাসার শরবত খেয়ে আমরা বেশ প্রাণোছ্বল ছিলাম, একদম সুগার বিহীন৷ এখন জানিস তো বিশাল সুগার আমার, ডাক্তার কতকিছু খেতে বারণ করেছে, তাও বাজার করে ফেরার সময় পাড়ার ওই মোড়ের মিষ্টির দোকানে মাঝেমাঝেই লোভের বশে রাবড়ি খেয়ে ফেলি।
মনে আছে তোর, এই দোকানের রাবড়ি খুব প্রিয় আমার, তাই তুই টিফিন কৌটো করে কোচিংয়ে নিয়ে আসতিস? ছুটির পর শীতের আলসে রোদ মেখে ঝিলের পাড়ে বসে খেতাম আমরা ৷ কত কি়ছু যে করেছি; সবকিছুই সময়ের চাকায় প্যাডেল করে জায়গা করে নিয়েছে স্মৃতির ঝুলিতে৷
তোর চোখের কাজলের কালো রেখা আমার হৃদয়াকাশে গোলাপি ঝড় তুলত, কিন্তু কখনও সেসব বলা হয়নি তোকে৷ তারপর হঠাৎ করেই কেমন যেন নিজেকে হারিয়ে ফেললাম৷ বন্ধুমহলে তখন আমার খুব পরিচিতি, চারিদিকে বসন্তের আবদার৷ সেই আবদারের নেশায় মেতে শীতের মিষ্টি রোদকে ভুলে পা বাড়িয়েছিলাম নকল বসন্তের নিপুণ ফাঁদে। তখন কিছু বুঝিনি, যখন পা আটকালো ফাঁদে ততদিনে শীত অনেকদূরে, অনেকদূরে এক বিয়ের মন্ডপে৷
তোর বিয়ের দিন তোর সিঁথির সিঁদুর দেখে মনে হয়েছিল সেটা আমার হৃদয়ের অজানা কোনো কোটরে ছিন্ন ধমনী থেকে নির্গত রক্তের রেখা হয়তো৷ সেদিন যদি তোর মনকে আমার মন পড়ত, তাহলে ছুটে গিয়ে একবার বলতাম, ”আবার একসাথে শীতের দুপুরে হারাতে চাই”।
পারিপার্শ্বিকতার লাল চোখে আমার সাহস হারায়। জানিস তো আমি খুব ভীতু ছিলাম, রাতে বাড়ি ফিরে সেদিন মদ দিয়ে কথা গিলেছিলাম৷ মনে মনে ভেবেছিলাম সব কথা হয়তো না বলাই হল, কিছু কথা চাপা পড়ুক নীরব প্রেমের ভূমিকম্পে৷
দূরত্ব বেড়ে যোগাযোগ নিভে গেলেও প্রথম ভালোবাসার অন্তরের যোগাযোগে দাঁড়ি পড়েনা, সেটা শরীরের শিরায় শিরায় বহে৷
তোর প্রশ্নের উত্তরে এইটুকুই বলতে চাই সব ভালোবাসাই তো আর পূর্ণতা পায়না, আমাদেরটা না হয় বেঁচে থাকুক ধুলোপড়া কিছু চিঠিতে, শীতের আমেজে, চিলেকোঠার জানলাটাতে আর অঙ্কের খাতায় ভুল হওয়া কিছু ইন্ট্রিগ্রেশনে, তাতে ক্ষতি কি!
অনুপমের ভাষায় যাকে বলে হয়তো ”…সব পেলে নষ্ট জীবন”৷

ইতি,
তোর স্বার্থপর

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *