পর্ব -১
বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করা বেশ মজার একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় যদি তাতে মজার উপাদান খুঁজে নেয়া যায়। রুহি বিজ্ঞান পড়তে একদম ভালোবাসতো না। তবে তার একজন শিক্ষক, বিজ্ঞানের সেই মজার উপাদানটি ধরিয়ে দেয় তাকে। তাই নিয়ে পরে আছে রুহি, বিগত পাঁচ বছর যাবত। ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স চেম্পিয়ন হিসেবেই পরিচিত। কোয়ান্টাম মেকানিক্স রুহির পছন্দের বিষয়। তাই নিয়ে কাজ করছে বিগত দুই বছর যাবত। ঘুম, খাওয়া দাওয়া, পরিবার, বিশেষ কেউ… কিছুই তার জীবনে ঠিকঠাক ভাবে নেই। আছে শুধু ল্যাব, কোড, আর প্রবলেম। এইসব নিয়েই যাচ্ছে সময়। এমনও সময় যায় যখন রাতে ল্যাবেই ঘুমিয়ে পরে রুহি।
আজও তাই। রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি পরছে। ল্যাবের জানালা সাধারণত খোলা থাকে না তবে, আজ হয়তো বাতাসেই খুলে গেছে। তাই বৃষ্টির ছিটেফোঁটা এসে পরছে রুহির মুখের উপর। রুহির ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে উঠে জানালা বন্ধ করলো। হাতের ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো চারটা বাজে। বাহিরে তাকিয়ে দেখলো বৃষ্টি পরছে। কিন্তু সে অবাক হয়ে গেলো আকাশের দিকে তাকিয়ে। আকাশ অন্ধকার না। নীল, বেগুনি মিলিয়ে একটা বিকেলের আকাশের রং ধারণ করেছে। অদ্ভুত ব্যপার! এতক্ষণ সে কখনো ঘুমায় নি। আজ এতো সময় ধরে ঘুমালো সে! নিজেই অবাক হয়ে আধো ঘুমে চোখ জড়িয়ে সে বেরিয়ে গেলো ল্যাব থেকে। ল্যাবের গেট খুলে আবার চমকে উঠলো সে। ল্যাবের বাহিরের দেয়াল, করিডোর, রুমগুলো ধুলোবালি দিয়ে ঘেরা। জানালাগুলোর কাঁচ ভাঙ্গা। দরজাগুলো পোকা খাওয়া। গতকালও তো সব ঠিক ছিল কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কি হলো?
হঠাৎ মনে হলো এই সময়ে তো প্রফেসররা অফিসে থাকেন। তাহলে এখনো তারা নিশ্চয়ই আছেন। অফিসের দিকে এগিয়ে গেলো রুহি। অফিস কেমন বদলে গেছে। ডান দিকের জানালাটা বালু সিমেন্টের দেয়াল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। প্রফেসরদের আলমারিটাও নেই। চেয়ার টেবিলে ধুলো জমা। মনে হচ্ছে যেন অনেক দিন কেউ এখানে আসে নি। সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। এক রাতের ভেতর কি হলো এমন! কোনো ঝর তুফান তো আসে নি আবার?
পায়ের পাশে কি যেনো একটা নরম কিছু অনুভব করলো রুহি। নিচে তাকাতেই চিৎকার করে লাফ দিয়ে উঠলো। তার চিৎকারে পায়ের কাছের ইঁদুরটাও ভয়ে দৌড় দিলো। হাফ ছেড়ে বাঁচলো। রুহি আনমনে সিড়ি বেয়ে নামছে।আবার চোখ আটকে গেলো তার। গোল সিড়ির মাঝখান থেকে একটা বিশাল গাছ ছাদ পর্যন্ত চলে গিয়েছে। এইবার একটু একটু ভয় হচ্ছে। কারণ তাদের ইউনিভার্সিটির ভেতরে গাছ ছিলো না কখনোই। বায়োলজির ল্যাবে বনসাই থাকতে পারে তবে এত বড় গাছ! অসম্ভব। মরে টরে তো যায় নি! নাহ, নাহ মরলে কি আর এইখানে থাকতো? নাকি রাতে কিছু হয়েছে? কফির মধ্যে তো কিছু ছিলো না? সে ভ্রান্তি, ভয় সবকিছু নিয়ে বড্ড অস্বস্তি বোধ করছে। তবে তার মাথা এখনো ঠান্ডা। “ফিজিক্স পড়তে হলে ধৈর্য্য রাখতে হয়”, মা এই কথাটা প্রায়ই বলতেন।অবশ্য পড়তে গিয়ে মায়ের কথাটা প্রমাণও হয়েছে বেশ কয়েকবার। অভিজ্ঞতার বলি আর বলি অভ্যাস, মাথা ঠান্ডা রেখে সব সমস্যার সমাধান করতে পারার ক্ষমতা রুহির আছে।
সে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো,” কেউ আছেন? কেউ কি আছেন আশে পাশে? দারোয়ান কাকা…”
কোনো শব্দ নেই। মেইন গেট থেকে বের হয়ে দেখলো, পুরো এলাকা জুড়ে দূর দূর পর্যন্ত কেউ নেই। বরং অনেক কিছু পরিবর্তন লাগছে। না, অনেক কিছু না সবকিছু। সবকিছু নেই। ওহ মাই গড! চারপাশে কোনো বিল্ডিং, মানুষজন, পাশে একটা সুপার শপ, সবকিছু কোথায় চলে গেলো? রুহি চিৎকার করে বলছে,” হ্যালো, কেউ আছেন? আশে পাশে কেউ আছেন? কি হয়েছিল? হেল্প.. হেল্প ..হেল্প মি প্লিজ।” মনে হচ্ছে যেনো চারিদিকে ধু ধু মাঠ আর তার মাঝে একটা ভাঙ্গাচোরা বিল্ডিং আর সামনে একটা রাস্তা।কি অদ্ভুত!
হঠাৎ মাথায় এলো, কোনো স্বপ্ন তো নয়? নিজের মাথায় জোরে জোরে দুটো বাড়ি দিয়ে দেখলো, যদি ঘুম ভাঙ্গে। তাতেও কোনো লাভ হলো না। কী করবে কিছুই মাথায় আসছে না। হতাশায় মাটিতে বসে পরলো রুহি। কী হচ্ছে? সবাই কোথায় চলে গেলো? সব এমন কেন লাগছে যেন শতাধিক পুরনো কোনো জায়গা। চারপাশটা ভালো করে দেখছে সে। একটা কিছু ইঙ্গিত যদি পাওয়া যায়। হঠাৎ খেয়াল করলো দূরে একটা কিছু ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। আর কিছুই মাথায় এলো না। সে উঠে দাঁড়ালো। কোনো দিকে না তাকিয়ে দৌড় দিলো। যেমন মরুভূমিতে ক্লান্ত পথিক মরীচিকা দেখে দৌড় দিয়ে মরীচিকার নিকটে পৌঁছানোর বৃথা চেষ্টা করে। তেমনি রুহি দৌড়াচ্ছে। পথও যেন ফুরোয় না। দৌড় দিচ্ছে, দৌড় দিচ্ছে। ক্লান্ত হয়ে আসছে পুরো শরীর। পায়ে যেন কোন বোধ পাচ্ছে না। নিশ্বাস ফুলে উঠছে। হাপিয়ে গেছে। পায়ের গতি ধীর হতে থাকলো, আর দীর্ঘ এবং ঘন ঘন নিঃশ্বাসের চেষ্টা বাড়তে থাকলো। অবশেষে সে একটু থেমে দাঁড়ালো। পিছু ফিরে তাকাতেই দেখলো সে অনেক দূর চলে এসেছে সে, তবুও সেই ঝাপসা বস্তুটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। সে হাঁপাতে হাঁপাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো। তার মনে পরলো বৃষ্টির ফোঁটা চোখে পরতেই তার ঘুম ভেঙ্গে ছিলো।এখন আবার দুপুরের মত রোদ। এতো তাড়াতাড়ি এই পরিবর্তন কিভাবে ঘটলো! এরকম আগে কখনো ঘটে নি। সে নিজের চোখে বিগত কিছু মিনিটে যা যা দেখলো সে তার কিছুই বিশ্বাস করতে পরছে না। কেমন একটা ঘোরে সবকিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে বারবার। সব অদ্ভুত, বিচলিত! মানসিকভাবে সে খানিকটা দুর্বল হয়ে গেলেও সে থামেনি।সে ধীরে ধীরে আগে বাড়তে থাকলো।
ফিজিক্সের কোনো সমস্যা যখন সে সমাধান করতে না পারে তখন সে সবকিছুর শুরু থেকে শুরু করে। সে এখনো সবকিছুর শুরু থেকে ভাবতে লাগলো। সে যেন নিজের চোখের সামনে সবগুলো ঘটনা শুরু থেকে প্লে করলো।
তার ঘুম ভাঙ্গলো, সে ঘড়ি দেখলো, ল্যাব থেকে বেরোলো… হঠাৎ থমকে গেলো রুহি। একজন বুড়ো লোক, একটা বাক্সের মত কিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুহি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” আপনি এখানে থাকেন? ” লোকটা ইশারা দিয়ে বোঝালো সে কথা বলতে পারে না। এবং সে এইখানে থাকে না। রুহি আবার জিজ্ঞেস করলো, “এখানে কোনো মানুষ নেই কেন?” উত্তরে লোকটা মাথা নেড়ে বোঝালেন ” সে জানে না ” ।
এইবার তো মাথা গরম হয়ে গেলো রুহির। না, মানি কাল রাতেও সব ছিল। সে ভাবলো, লোকটা পাগল তো নয়? তাই যাচাই করার জন্য প্রশ্ন করলো, “এই জায়গাটার নাম কি জানেন?”
লোকটা রুহির পাশের বিলবোর্ড এর দিকে ইশারা করলো।রুহি বিলবোর্ডের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেলো।চোখের সামনে অন্ধকার ছেয়ে গেলো ক্ষণিকের জন্য।
“পরিত্যাক্ত!”