|| সান্যালদের রক্তাক্ত ইতিহাস ||
– মা, বাবা, বড়দা, মেজদা, বৌদি বাইরে এসো, দ্যাখো কে এসেছে!
– কিরে কি হল, এত চেঁচাচ্ছিস কেন?
– আগে এসোই না বাইরে…
– ও মা! কৃষ্ণা তুই? বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন রে হতভাগী। ভেতরে আয় তাড়াতাড়ি।
কালীপূজোর পরদিনের সকালটা এভাবেই শুরু হল সান্যাল পরিবারের। চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মাটির প্রদীপ, শুকনো ফুল বাড়ির চাকর ঝিয়েরা পরিষ্কার করছিল তখন। সকাল সাড়ে ছ’টা। প্রসূন প্রাতঃভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরেই দেখে সদর দরজার সামনে পালকি থেকে নামছে কৃষ্ণা।
কৃষ্ণা সান্যাল বাড়ির ছোট মেয়ে। বিয়ে হয়েছে তিন গাঁ দূরে হাজিপুরে। প্রতিবছরের মত এবারও ভাইফোঁটায় বাপের বাড়ি এসেছে সান্যাল বাড়ির একমাত্র কন্যা। চার দাদার বড় আদরের বোন। কৃষ্ণা দ্বাদশীর দিনে অনেক বছর পর বাড়িতে প্রথম কন্যাসন্তান হওয়ার খুশিতে কালি সান্যাল মেয়ের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণা।
– কিরে, জামাই বাবাজীবন এলো না যে!
– বাবা, ও তো দিদির বাড়ি গেছে। ফোঁটা নিয়ে এখানে আসবে…
– ও আচ্ছা। তুই যা স্নান সেরে আয়। আজ আবার বাপ-মেয়েতে একসাথে লুচি আলুর দম খাবো।
কালিনাথ সান্যাল, ওরফে কালি ডাকাত। যার কথায় আশেপাশের পাঁচ গায়ে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়। সান্যাল ডাকাতদের যত বেশি বদনাম, তার চেয়ে অনেক বেশি সুনাম। সান্যালদের বিরাট বাড়িতে জনা পঁচিশ লোকজন। তবে প্রতিদিন প্রায় ষাট-সত্তরজন লোকের জন্য হাড়ি চাপে হেঁসেলে। আজ পর্যন্ত সান্যাল বাড়ি থেকে কেউ সাহায্য চেয়ে ফিরে যায়নি। কিন্তু দরদি কালি সান্যালের রূপ হিংস্র হতে সময় লাগেনা একটুও। ডাকাতির সময় প্রায় সবাইকে জানে মেরে ফেলায় কালি সিদ্ধহস্ত। কালি সান্যালের চার ছেলে, যোগেন্দ্র, বলাই, প্রভাত আর প্রসূন। এদের মধ্যে প্রসূন একেবারে আলাদা মাটিতে তৈরি। সে তার বাবা-দাদাদের মত কোনোদিনও ডাকাতির পথ মাড়ায়নি। সারাদিন নিজের খেয়ালে থাকে আর বই পড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে। প্রসূন আবার বোনের খুব ন্যাওটা। বিয়ের আগে সারাদিন দুই ভাইবোনের খুনসুটি লেগেই থাকত।
“ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা…
কাঁটা যেন নড়ে না, ভাই যেন মরে না।”
একে একে চারভাইকে ফোঁটা দিল কৃষ্ণা। কত উপহার, কেউ সিতাহার, কেউ বালা, কেউ জামদানি শাড়ি… আরও কত কি। প্রসূন তার বোনকে দিল ‘কপালকুণ্ডলা’। দুপুরে চোদ্দ পদ দিয়ে খাওয়া-দাওয়া হল। ভাইবোনে মিলে গল্প করতে করতে সন্ধ্যে হয়ে এলো।
কানু, রশিদ, জয় সবাই রেডি। কালি ডাকাতও ধুতির মালকোঁচা দিয়ে চলল অভিযানে। মা পথ চেয়ে বলে উঠল, “দুগ্গা, দুগ্গা…”।
“সর্দার… সর্দার… দূরে ওই আলো দেখা যাচ্ছে।” কালি সান্যাল মাথা তুলে দেখে নিল। জনা দশেকের দলটার কারও হাতে লাঠি, কেউ দাঁ, কেউ বল্লম আর কালির হাতে তার প্রিয় মণিপুরী ছোঁরা। রাস্তার দু’পারে সবাই নিজের অবস্থান ঠিক করে নিল। পালকিটা এগিয়ে আসছে ক্রমশ… চারজন বেহারা… হুম্না… হুম্না… হুম্না… সুরে রাতের স্তব্ধতায় ঝিঁঝিঁপোকার ডাকের মত গুঞ্জিত হতে হতে পালকিটা প্রায় সামনে চলে এলো। সঙ্গে সঙ্গে চারজন বেহারার ওপর হামলে পড়ল ডাকাতদল। মাথায় লাঠির আঘাত, পেটে ছুঁড়ি চলল অহর্নিশে।
– সর্দার ভেতরে একজন আছে।
– যা আছে নিয়ে নে… (পথের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল কালি)
আরেক প্রস্ত ধস্তাধস্তি চলল। রাংতায় মোড়া কিছু প্যাকেট, সোনার চেন, আংটি, বালা সব খুলে নিল আস্তে আস্তে।
– সর্দার, হাতের আংটিটা খুলছে না কিছুতেই… খুব শক্ত করে আঁটা… চেষ্টা করছি…
– তোদের এখনও শেখাতে পারলাম না… আঙ্গুল সুদ্ধু কেটে নিয়ে চল।
তড়িঘড়ি সব নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সান্যাল ডাকাতের দল।
পরদিন সকালে উঠোনে মাদুর পেতে আগের রাতের ডাকাতির মাল দেখার পালা চলছে। বাবার পাশে বসে ডাকাতির জিনিস দেখছিল কৃষ্ণা, ছোট থেকে এই অভ্যেস ওর।
– এত দেখি সব উপহার, ব্যাটা নিশ্চয়ই কোন আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছিলো।
– বাবা দ্যাখো শাড়িটা কি সুন্দর, এটা আমি রেখে দিই…
একে একে বিভিন্ন শাড়ি, গয়নাগাঁটি, সোনার চেন, বালা… হঠাৎ ঝুলি থেকে বেরোলো সেই কাঁটা আঙুল, আঙুলে সোনার আংটি। বিলিতি নকশা কাটা আংটিটায় অপরূপ দক্ষতায় একটা পালক আঁকা। কাঁটা আঙ্গুলে আংটিটা দেখতেই কৃষ্ণা “বা…” বলে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। মা ছুটে এলো কৃষ্ণার কাছে, কাছে আসতেই কাঁটা আঙ্গুলটায় চোখ পড়তেই চিৎকার করে উঠল, “এটা তো জামাইয়ের…” হাউমাউ করে কালি সান্যালের বুকের ওপর পাঞ্জাবিটা খিমচে ধরে মাথা ঠুকতে লাগলো। একটা অদ্ভুত নৈশব্দের মধ্যে মায়ের হাহাকারের শব্দ তখন যেন সুপ্ত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুতপাতের মতই ভয়ঙ্কর। হঠাৎ সদর দরজা দিয়ে দৌড়ে এলো কানাই,
– সর্দার… সর্দার কাল রাতে সর্দার… ওই লোকটা… লোকটা… কৃষ্ণা দিদিমণির… সর্দার… এ কি হয়ে গেল সর্দার…।
কালি সান্যালকে কেউ কোনোদিনও কাঁদতে দ্যাখেনি। আজও তার অন্যথা হল না। এক ফোঁটাও জল পড়ল না কালি ডাকাতের চোখ থেকে। শুধু কেমন যেন গুম মেরে পড়ে রইলেন। কৃষ্ণাকে তুলে নিয়ে ঘরের ভেতর নিয়ে যাওয়া হল।
বিকেল ঘনিয়ে তখন সন্ধ্যা নামব নামব করছে। কালি সান্যাল কাউকে না জানিয়ে মেয়ের ঘরের দিকে গেলেন। কৃষ্ণা তখন ফ্যাকাশে চোখে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে। পলক পড়ছে না অনেকক্ষণ। কালি গিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন আলতো করে।
– মা, মাফ করে দিস আমাকে। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।
পাশ ফিরে বালিশে মুখ চাপা দিল কৃষ্ণা।
– কপালের লিখন, কেউ খণ্ডাতে পারে না কৃষ্ণা।
(উত্তর আসে না…)
– কাঁদিস না মা। তুই সান্যাল বাড়ির মেয়ে! চোখের জল ফেলতে আছে তোর! কিচ্ছু শেষ হয়নি মা। তুই আবার…
কৃষ্ণা সহসা বাবার দিকে রক্তদৃষ্টিতে তাকায়।
মেয়ের চোখের রক্তিম আভায় আর কিছু বলার সাহস পেলেন না কালি সান্যাল । তিনি উঠে চলে গেলেন নিজের ঘরে।
আজ সারাদিন সান্যাল বাড়ির কেউ কিচ্ছুটি মুখে তোলেনি। সাঁঝের বেলায় তুলসীতলা অন্ধকার। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলে গেছে মায়ের। দাদারাও নিজেদের ঘরেই আছে সারাদিন। কৃষ্ণা কাউকে নিজের কাছে থাকতে দেয়নি বেশিক্ষণ। এখন আর কাঁদছেও না সে। শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। মাঝে মাঝে কিসব যেন বিড়বিড় করে বলছে। আবার চুপ।
বিকেলের পর থেকে কালি সান্যাল একটাও কথা বলেনি। ছাদে গিয়ে পায়চারি করেছে কিছুক্ষণ। তারপর থেকে বিছানায়। তবে ঘুমহীন। মাঝে একবার কৃষ্ণার কাছে যাবে ভেবেছিলেন। কিন্তু শেষমেশ আর যাননি।
আজ সকালে প্রসূন রোজকার মত প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিল। ফিরে এসে ঝি-চাকর ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলনা বাইরে। সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, কৃষ্ণার ঘরের দিকে গেল।
– কৃষ্ণা… বুনু দরজা খোল। আমি প্রসূন।
সাড়া নেই।
– বুনু আমার সাথে কথা বল। দরজা খোল একবার। ওই বুনু… ওই…
তবুও সাড়া নেই।
বেশকয়েকবার দরজায় ঠোকা দিল সে। শেষ তিনবার বেশ জোরেই। তবুও সাড়া নেই। এবার চিন্তা হল ওঁর।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গোটা বাড়ি হাজির হল কৃষ্ণার ঘরের সামনে। আরও এক প্রস্ত ডাকাডাকির পর ঠিক হল যে এবার দরজা ভাঙা ছাড়া আর উপায় নেই। বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায় দরজা খুলল। ওপর থেকে কৃষ্ণার নিথর দেহটা পেন্ডুলামের মত ঝুলছে। চোখদুটো খোলা, প্রাণহীন চোখদুটি এখনও যেন শূন্যের দিকে তাকিয়ে। দাদারা ধরাধরি করে নীচে নামাল দেহটাকে। মা কেঁদে চলেছে পাগলের মত, কালি সান্যালকে দোষ দিয়ে যাচ্ছে অনবরত। কালি সান্যাল তখনও কাঁদেননি। চোখ ছলছল করছিল হয়তো। কিন্তু কাঁদেননি উনি। মৃতা কন্যার দেহ সৎকারের সময়ও চোখের জল ফেলেননি এক ফোঁটাও। শুধু সৎকারের শেষে ছেলেদের সামনে গিয়ে একবার বলেছিলেন,
“আজ থেকে সান্যাল ডাকাতের নাম যেন চিরদিনের জন্য মুছে যায়…”
হ্যাঁ সেদিন থেকে সান্যাল ডাকাতদের নাম আর শোনা যায়নি। তবে ইতিহাস ভুলতে পারেনি সান্যাল ডাকাতদের; কৃষ্ণার মৃত্যু সান্যালদের ইতিহাসে মর্মান্তিক রক্তের দাগ রেখে গেছে, যা মুছে যায়নি কোনোদিনও…