– ধ্রুব, আয় খেয়ে নে, অনেকক্ষণ কিছু খাসনি।
– না মা, আর কয়েকটা করলেই ১০০০ টাকার হয়ে যাবে আর তারপর শ্যাম কাকুর দোকানে যাব। ওরা বলেছে, আমি পৌঁছে দিতে গেলে ২০ টাকা বেশি দেবে।
– আচ্ছা আয়, তাহলে আমিই তোকে খাইয়ে দিই অল্প করে। তারপর তোর সাথে বেরিয়েই বিন্দিদের বাড়ির কাজটা সেরে আসব।
– হ্যাঁ মা, যাওয়ার সময় ওদের তুবড়ি গুলো নিয়ে যেও, আমি ফেরার সময় টাকাটা নিয়ে আসব। ফেরার সময়ও আমরা একসাথে ফিরবো, একদম ভেবোনা, আমি বেশি দেরি করবোনা।
আমি ধ্রুব। চম্পাহাটির এক বস্তিতে আমার আর মায়ের ছোট্ট সংসার। মা বলে কালীপুজোর সময় আমি জন্মেছি বলে, বাবা শখ করে আমার নাম রেখেছিল ‘ধ্রুব’। বাবা খুব বেশি পড়াশোনা করেনি কিন্তু তার জ্ঞান ছিল অনেক। বাবাও বাজি বানাতো, শুনেছি এ তল্লাটে তার মতো তুবড়ি কেউ বানাতে পারত না। আর দেখো, সেই তুবড়ি বানাতে গিয়েই বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেল। তারপর থেকেই শুরু হল আমার আর মায়ের বেঁচে থাকার লড়াই। মা বাড়ি বাড়ি কাজ করার সাথে সাথে বাড়িতে বাজি বানাতে আমাকে সাহায্য করে।
বাবা চেয়েছিল আমি এই ছোট্ট দুনিয়া থেকে বেরিয়ে অনেক দূর যাব আর ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল হবে আমার নাম। কিন্তু আমার গন্ডিটাও কীভাবে যেন এই ছোট্ট দুনিয়ায় আটকে গেল। তবুও আমি স্বপ্ন দেখা থামাইনি, আমি স্বপ্ন দেখি এই ঝুপড়ি বস্তির টিমটিমে আলো থেকে বেরিয়ে ‘ধ্রুব’তারা হওয়ার।
সবাই বলে ‘দিওয়ালি’ আলোর উৎসব। সমস্ত অন্ধকার কাটিয়ে ‘দিওয়ালি’ ঘরে ঘরে আলো এনে দেয়। আমার মাও খুব যত্ন করে ঐদিন প্রদীপ দিয়ে ঘর সাজায়; আর এভাবেই ঘরে নতুন করে আলো আসার বিশ্বাসের সলতেটা একটু একটু করে জ্বালিয়ে রাখে।
প্রতি বছর বিন্দি, তমাল, রিয়া, সায়নরা প্রচুর বাজি পোড়ায়। তিনদিন ধরে বাজির আলোয় পাড়া আলোময় হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, ওরা আমার থেকেই বাজি কেনে, আমি আর মা মিলে বাজি বানাই। ওদের জন্য বাজি বানাতে বানাতে, কখনো আমারও ইচ্ছে করে, নিজেকে ওদের জায়গায় দেখতে। ইচ্ছে করে ফুলঝুরির ঝকঝকে আলোয় মায়ের হাসিতে রাঙা মুখটা দেখতে কিংবা তুবড়ির উচ্চতা দেখে আনন্দে হাততালি দিতে বা সবার সাথে মিলে চড়কির সাথে লাফাতে। কিন্তু পরমুহুর্তেই তুবড়ির মশলা আমাকে বাস্তবের মাটিতে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
বাবার ইচ্ছে ছিল আমি অনেক পড়াশোনা করি। তাই অনেক অভাবেও মা আমাকে স্কুলে যেতে আটকায়নি। আমি এখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। সারাদিন বাজির মশলার মাঝে থাকলেও আমার বইয়ের গন্ধ বেশি পছন্দের। যখন রাতের বেলা ঢুলুঢুলু চোখে বইয়ের শব্দগুলো দেখি, তখন আবার করে স্বপ্ন জাগে বাবার ‘ধ্রুব’তারা হওয়ার।
আলোর উৎসবে আনন্দে মত্ত হয় সবাই। শত অন্ধকারেও ছোট্ট আলোর রেখা যেন আমার জীবনকে আলোয় থাকার সাহস জাগায়। অন্যান্যদের জন্য বাজি বানাতে বানাতে চোখে একরাশ স্বপ্ন রাখি বাজি পোড়ানোরও।
বাবা বলতো, ‘তুমি ভালো ভাবলে, সমস্ত পৃথিবী চাইলেও তোমার খারাপ হবেনা।’ তাই বাবার আদর্শে আদর্শায়িত হয়ে আমি ভালো ভাবি; মাকে সাথে নিয়ে ‘ধ্রুব’তারা হওয়ার কথা ভাবি।
ধ্রুব পেরেছে; সত্যি বুঝতে, সত্যি মানতে। তবে পারেনা অনেকেই। সমাজের বৈষম্যের লড়াইয়ে বারবার তারা হেরে যায়। শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে বারবার প্রশ্ন উঠলেও, সমাধানের উত্তর না পাওয়াই থেকে যায়। হ্যাঁ, ধ্রুবসত্য এটাই যে, ধ্রুবরা বাঁচার তাগিদে লড়ে যায় আর স্বপ্ন দেখে ধ্রুবতারার মতো চিরস্থায়ী হওয়ার।।