অ-তে আন্দামান এই কথাটা তখন বলতে পারতো না আমার মেয়ে। তার বয়স মাত্র তখন এক। প্রথম বছরের জন্মদিন ঘটা করে পালন না করে আমরা তাকে দ্বীপ দেখানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। পাহাড় ধসে অনেক দেখেছে। এবার তাকে সমুদ্র দেখাবো। এই চিন্তা ভাবনা নিয়ে আন্দামানে যাত্রা শুরু। টিকেট কেটে ফেললাম ৭ জনের। ফ্যামিলি ট্রিপ বলে কথা। বাবা মা, শ্বশুর শাশুড়ি, বোন সবাই একজোট। অনেক দিনের ইচ্ছা পূরণ হবে এবার। মেয়েরও সেই প্রথম প্লেনে চড়া। সব মিলিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা ও রোমাঞ্চ নিয়ে শুরু হলো যাত্রা।
আন্দামান শুনলেই মাথায় আসে কালাপানি, সেলুলার জেল আর অচেনা সবুজ দ্বীপের কথা। বাঙালির ভ্রমণপিপাসু মন সবসময় খোঁজে নতুন নতুন ডেস্টিনেশন। তবে আন্দামান নতুন এখন নয়। প্রায়ই লোকে ছুটি কাটাতে চলে যাচ্ছে। আমাদেরও এমনই এক মন তৈরি হয়েছিল এই সবুজ দ্বীপের সৌন্দর্য উপলব্ধিৎ করার।
কলকাতা থেকে বিমান বা জলপথে আন্দামানের রাজধানী পোর্টব্লেয়ার যাওয়া যায়। এখন বিমান যাত্রা সস্তা ও সময় বাঁচে,তাই অনেকেই আকাশপথ পছন্দ করছেন। বিমানে যাওয়ার জন্য খরচ পড়ে মোটামুটি ৩,৫০০ টাকা থেকে ৭,০০০ টাকার মধ্যে। আন্দামানে থাকা একটু খরচ সাপেক্ষ এমন একটা ধারনা আছে অনেকের, তাঁদের অবগতির জন্য জানাই সেখানে কিন্তু নানা মানে ও নানা দামে থাকার ব্যবস্থা আছে।
হাত বাড়ালেই সৈকত। পা চালালেই বালি ভিজিয়ে ছুটে আসা খ্যাপা জলের দামালপনা। ৫৭২টি দ্বীপের রাজমহিমা শোনাতে গেলে প্রত্যেকেই বলে উঠবে ‘আমার কথা লেখো’। আমিও কি ছাই সব দ্বীপে গিয়েছি নাকি! না কি সবার হাঁড়ির খবর আমার জানা আছে? তাই একটু নিষ্ঠুর হতেই হয়। বরং পাটরানী, সুয়োরানী দিয়েই শুরু করি। বড় জোর দুয়োরানির প্রসঙ্গও আসতে পারে, তবে বাকিদের কথা পরে কখনও, অন্য কোনওদিন।
পোর্টব্লেয়ার
সৈকত: আবেরদিন বাজার থেকে মাত্র ৬ কিমি দূরে নারকেল গাছে ছাওয়া স্নানের উপযোগী বিখ্যাত করবাইনস কোভ বিচ। সৈকতটি যেন অনেকটা বাঁকানো চাঁদের মতো। কোরাল সাইটিং ও সাঁতার কাটার জন্য আদর্শ স্বচ্ছ নীলাভ জলের ওয়ান্ডুর সৈকতটি পোর্টব্লেয়ার থেকে ২৫ কিমি দূরে অবস্থিত। যাওয়ার জন্য বাস মিলবে। কাছেই কোরাল মিউজিয়াম। একটু অ্যাডভেঞ্চারের নেশা থাকলে সকাল সকাল বেরিয়ে বিচ সংলগ্ন গুহা দেখে আসতে পারেন।
জলিবয় দ্বীপ যাওয়ার লঞ্চ ছাড়ে। পোর্টব্লেয়ার থেকে মোড়ক সফরেও এখানে আসতে পারেন। মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত ১৫টি দ্বীপের অন্যতম একটি হল এই জলিবয়। এ দ্বীপে জলকেলির অগাধ ব্যবস্থা আছে। স্নরকেলিং চশমায় অগভীর জলের ভেতরের প্রবাল দেখতে পোশাক ভাড়া পাওয়া যেমন, তেমনি ফাইবার গ্লাস বটম বোটে সমুদ্রের তলার প্রবাল জগৎও দেখে নিতে পারেন। ওয়ান্ডুর জেটি থেকে রেড স্কিল দ্বীপেও যাওয়া যেতে পারে।
পোর্টব্লেয়ার সংলগ্ন আরও দুটি বিখ্যাত দ্বীপ হল রস ও ভাইপার আইল্যান্ড। নারকেল গাছে ভরা ২ কিমি পূর্বে অবস্থিত একদা প্রশাসনিক সদর রস আইল্যান্ড এখনও কোয়ার্টার্স, চার্চ, সমাধিস্থল, সেনা মিউজিয়াম, হাসপাতাল, টেনিস কোর্ট– এইরকম অনেক ব্রিটিশ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। অন্য দিকে পুরনো জেল, ফাঁসিমঞ্চের মতো বিষাদগাঁথায় ভরা ভাইপার আইল্যান্ড। তত্কালীন ব্রিটিশ রাজত্বে এই দ্বীপে মহিলা কয়েদীদের রাখা হত ও ফাঁসি কাঠে ঝোলানো হত। একই দিনে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে এই দুটি দ্বীপ দেখে নিতে পারেন। আবেরদিন জেটি থেকে লঞ্চ ছাড়ে। রস ও ভাইপার যেতে সময় লাগে যথাক্রমে পৌনে এক ও দেড় ঘন্টা। সকালে রস দেখে এসে বিকেলে স্বচ্ছন্দে ভাইপার বেরিয়ে ফেরা যায়। বেশ কিছু বেসরকারী সংস্থা এই দুই দ্বীপ ও সঙ্গে নর্থ বে কোরাল আইল্যান্ডের মতো অন্য কিছু দ্বীপ জুড়ে নিয়ে মোড়ক-সফরের ব্যবস্থা রেখেছে। সে পথেও যেতে পারেন।
হ্যাভলক ও নীল দ্বীপ
একদা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি উদ্বাস্তুরা ঘর বেঁধেছেন হ্যাভলকে। তাই রাধানগর, বিজয়নগর কিংবা গোবিন্দনগর নামের কিছু অপরূপ সৈকত নজরে আসবে আপনার। কেমন বাঙালি নাম। ভারী সুন্দর এই হ্যাভলক দ্বীপ। ধানখেত, নারকেল, সুপারি, আম, কাঁঠালে ছাওয়া আদ্যন্ত বাংলার পরিবেশ যেন। একদিকে প্রবাল সাগর, অন্যদিকে হালকা অরণ্য। মন ভাল করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। দ্বীপের ওপ্রান্তে রাধানগর সৈকত। গোধূলীতে সেখানে আকাশে আগুন লাগে। নীলাভ ঢেউয়ের পাশে বালুকাবেলায় বসে সূর্যের সেই লালাভ সংলাপ শুনতে শুনতে নিজেকে মেলে ধরুন। কিন্তু এতো গেল অপরাহ্নের কথা, হ্যাভলকের রাধানগর সৈকতে ভোর হওয়াটাও কিন্তু অসম্ভব সুন্দর। রাজকীয় মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে যখন সেখানে সূর্যদেব জাগেন ভাঁটার জল সরে যাওয়া সৈকতটি তখন স্যান্ডপাইপার, প্লোভার আর কাঁকড়াদের দখলে। স্পিড রাইডারে ঘুরে আসতে পারেন সংলগ্ন এলিফ্যান্ট বিচ। গভীর জলের কোরাল রিফ সেখানে অসাধারণ হয়ে ধরা পড়ে। স্নরকেলিং ছাড়াও নানা জলবিহারের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।
নীল দ্বীপকে ঘিরে আছে নানা বর্ণময় জল। বিভিন্ন সময়ে তার পরিবর্তন নজরে পড়ে। সেখানে তুঁতে নীল বা পান্না সবুজ বা এমন এমন রঙের বাহার যে তার নাম জানি না। এই দ্বীপেও বাঙালি প্রাধান্য। এখানকার নজরকাড়া সৈকতের নাম সীতাপুর।
মায়াবন্দর
যেমন সুন্দর নাম, তেমনি নেশা ধরানো পরিবেশ। পাহাড়ি ঢালে গাছগাছালি। পান্না সবুজ জলরাশি। সবুজের সঙ্গে নীলের এক সুগভীর সখ্য এখানে। বেশ বড় জনপদ মায়াবন্দর। বন্দর শহরও বলা যায় একে। জল-জঙ্গলের এমন সুন্দর কবিতা আর কোথায় লেখা হয়েছে জানি না, তবে মায়াবন্দরের কারমাটাং সৈকতের মতো এমন আশ্চর্য সুন্দর বেলাভূমি খুঁজে পাওয়া ভার।
ডিগলিপুর
কেওড়া, গড়ান, হেতালের মতো ম্যানগ্রোভ অরণ্যের অসাধারণ সৌন্দর্য নিয়ে ডিগলিপুর চলুন। গোটা রাস্তাটাই চমত্কার। বাসে সময় লাগে ঘন্টা চারেক। ভাড়া গাড়িও পাবেন। উত্তর আন্দামানের একেবারে উত্তরপ্রান্তে এই ডিগলিপুর। অরণ্যের সবুজ, সমুদ্রের নীল আর আকাশের সাদা মেঘের রঙে ডিগলিপুরে যেন ক্যালাইডোস্কোপের বাহার। এখানেও বাঙালি আবহ।
বারাটাং
মিডল আন্দামান জেলার রানি এই বারাটাং।পোর্টব্লেয়ার থেকে মোটামুটি ১০০ কিমি দূরে এর অবস্থান। জলপথ বা সড়ক দু’পথেই আসা যায় এখানে। সড়ক পথে গেলে ধরতে হবে আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড, যা জারোয়া অধ্যুষিত অঞ্চল হয়ে যাবে। সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘন্টার মতো। পোর্টব্লেয়ার থেকে জিরকাটাং এবং সেখান থেকে নিলাম্বর হয়ে বারাটাং যেতে হয়। ম্যানগ্রোভ ঘেরা খাঁড়ি পথ বেয়ে বেয়ে অ্যাডভেঞ্চার আর অশেষ উত্তেজনার দ্বীপ এই বারাটাং।
ভারতের একমাত্র মাড ভলকানো এখানেই আছে। স্থানীয়দের কাছে এটি জলকি নামে পরিচিত। গত ২০০৫ সালে এখানে এখন অব্দি শেষ অগ্নুৎপাত হয়েছে। তার আগেরটি ঘটেছিল ২০০৩ সালে। এখানকার লাইমস্টোন কেভ দেখতে ভুলবেন না।সবুজ দ্বীপটা ভেতরটাকে আরো বেশি করে সবুজ করে তুলেছিল।
মৌমিতা ভাওয়াল দাস।