সব তৈরী। জ্যাকেট-মোজা-টুপি। বাঙালির দার্জিলিং সফলের জন্য যা যা দরকার হয় সবকিছু।এক ব্যাগ উৎসাহ নিয়ে আমরা একদল ট্রেনেও চেপে বসলাম সময় মতো। কিন্তু ট্রেনে চাপার ঘণ্টা তিনেকর মধ্যেই খবর পেলাম পাহাড়ে গন্ডগোল শুরু হয়েছে।
অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ।ট্রেন থেকে নেমে পরব আর সে উপায়ও নেই। তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হল, যে ডুয়ার্স ঘুড়ে দেখা হবে। বুকিং আগে থেকে ছিল না। তাই বিপদে পড়বো আশা নিয়ে রাস্তায় নেমে ছিলাম।আমার বাবার এক পরিচিত দাদা, অনেকদিন এই উত্তরবঙ্গে পোস্টেড ছিলেন। তাকে ফোন করে বাবা প্রথম জানতে পারেন, চিলাপাতার কথা। শেষ মুহূর্তে রিসোর্ট,হোটেল পাওয়া অসম্ভব বলে,ঠিক হয় আমরা হাসিমারা কোন হোটেলে গিয়ে উঠব। তারপর সেখান থেকেই বিভিন্ন জঙ্গল ঘুরে দেখব ডুয়ার্সের।
সেদিনের মতো ফ্রেশ হয়ে হোটেলের মালিককে কাছাকাছি এসব ডুয়ার্সের জঙ্গল ঘুরে দেখার আমাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে, তিনি চিলাপাতার প্রশংসা শুরু করেন।তবে বাবা যাওয়ার জন্য গড় রাজি ছিলেন। কারণ, আমরা আগেও অনেক শুনেছি ডুয়ার্সের জঙ্গল এর কথা। কিন্তু ডুয়ার্সের জঙ্গল বলতে, গরুমারা জলদাপাড়া কথাই শোনা যায়। চিলাপাতার কথা কেউ কখনো বলেনি খুব একটা। কিন্তু হাসিমারার হোটেলের মালিক জোড় করায় চিলাপাতা ফরেস্ট, আমাদের ঘোরার প্লানে শামিল হয়।
তার কথায় বাবা নিমরাজি হয়েও একটা গাড়ি বুক করে ফেলান। পরদিন সকাল সকাল আমরা রেডি হয়ে যাই।হাসিহমারার আমাদের হোটেলটা ছিলো হাসিমারা গুরুদুয়ারা ঠিক পাশেই। গাড়ি ছাড়ার সময় হোটেলের মালিক আমাদের বলল সোনাপুর মোড় পর্যন্ত গিয়ে তারপর আবার সেখান থেকে ফিরে আবার হাসিমারা পর্যন্ত আসতে। কিন্তু জঙ্গলটা ঠিক করে দেখানোর জন্য আমাদের প্রয়োজন একটি গাইডের। তার ব্যবস্থা হয়ে গেল তরিঘড়ি।
আমাদের সেদিনের ফরেস্ট গাইড, দীপেনদা আমাদের জঙ্গল সম্পর্কে অনেক না জানা কথা জানালেন। তার সংক্ষিপ্তকরণ এই রূপ,পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশের জলপাইগুড়ি বিভাগের ছটি জেলা নিয়ে উত্তরবঙ্গ গঠিত। এই অঞ্চলের উত্তরে সিকিম ও ভুটান; পূর্বে অসম এবং বাংলাদেশের রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ; দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গের প্রেসিডেন্সি বিভাগ ও পশ্চিমে বিহার ও নেপাল অবস্থিত।
গঙ্গা নদী দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গকে পৃথক করেছে।
উত্তরবঙ্গের ছটি জেলা: কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদহ। ভৌগোলিকভাবে এই অঞ্চলটি উত্তরে দার্জিলিং হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল ও দক্ষিণে গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের মধ্যবর্তী তিস্তা-তোর্ষা-মহানন্দা অববাহিকায় অবস্থিত।অর্থনৈতিক দিক থেকে উত্তরবঙ্গ দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় পশ্চাদপদ। তবে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্যে এই অঞ্চলে পর্যটন শিল্প খুবই উন্নত। শিলিগুড়ি উত্তরবঙ্গের প্রধান শহর; এই শহর একাধারে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মহানগর এবং সমগ্র উত্তরপূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার।
উত্তরবঙ্গের অন্যতম বেড়ানোর জায়গা চিলাপাতা বনাঞ্চল।জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের প্রতিবেশী চিলাপাতা অরণ্য, আলিপুরদুয়ার জেলায়। আলিপুরদুয়ার শহর থেকে ২০ কিলোমিটার, হাসিমারা শহরের খুব কাছে।কোচ রাজবংশের আদি পুরুষ বিশ্ব সিংহের তৃতীয় পুত্র চিলা রায়।
ডুয়ার্সের সীমানায় আলিপুরদুয়ারের কাছে গভীর অরণ্যে চিলা রায় এক দুর্গ নির্মাণ করেন। সে দুর্গ রাজা নরনারায়ণের নামে পরবর্তী কালে নল রাজার গড় নামে পরিচিত হয়। আর যে অরণ্যে এই দুর্গ নির্মাণ করান চিলা রায় সেই অরণ্যই আজ চিলাপাতা অরণ্য নামে খ্যাত।
চিলাপাতা অরণ্য জলদাপাড়া আর বক্সা টাইগার রিজার্ভের মধ্যে হাতি চলাচলের পথ। এক সময়ে এই জঙ্গলে প্রচুর গণ্ডার ছিল। কোচবিহারের রাজারা এই জঙ্গলে গন্ডার শিকার করতেন। এখন গণ্ডারের সংখ্যা কিছু কম। তবে প্রচুর লেপার্ড আছে এই চিলাপাতায়।
মাদারিহাট বনবাংলোয় থেকে ঘুরে নেওয়া যায় চিলাপাতা। জঙ্গলের গভীরে একটি নজরমিনার আছে। অসাধারণ অবস্থা সেই টাওয়ারের, একেবারে ঘন অরণ্যে, শীলতোরসা নদীর পাড়ে। এখানে দিনে দুপুরে হাতি চরে বেড়ায়। কপাল তেমন হলে গণ্ডারও দেখা যায়। নদীর চরে কচি কচি ঘাস খেতে আসে হরিণের দল। এই ওয়াচটাওয়ারে কিছু ক্ষণ কাটিয়ে চলে যেতে পারো নল রাজার গড় দেখতে। কিছুই অবশ্য অবশিষ্ট নেই গড়ের, গোটা কতক ইটের দেওয়াল ছাড়া। তবে পরিবেশ অসাধারণ, একেবারে নিবিড় অরণ্য।
দীপেনদার তার মুখে এসব গল্প শুনতে শুনতে আর 42 কিলোমিটার রাস্তার ধারে এই অপূর্ব জঙ্গলের সবুজ জাভা গায়ে মাখতে মাখতে মনটা যেনো উদাস হয়ে গেলো।মন থেকে যেতে চাইছিলো, প্রকৃতি মায়ের এই আদরে-আহ্লাদে। এত গল্প শুনতে শুনতে আমাদের যদিও জঙ্গল সাফারির কথা মনে ছিল না। কিন্তু একদিনের চিলাপাতা সফরে জঙ্গল সাফারি ইনক্লুডেড থাকায় দীপেনদা নিজেই বিষয়টি সমস্যাটা তুলে ধরেলেন।
তার অভিযোগ,জলদাপাড়ার অন্যত্র চালু রয়েছে অনেক দিন থেকেই। কিন্তু একই নিয়মে চিলাপাতাতেও বন দফতর এ বার বৃহস্পতিবার করে পর্যটকদের জন্য ‘কার সাফারি’ বন্ধ করে দেওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে সেখানকার পর্যটন ব্যবসায়ীদের মধ্যে। তাঁদের অভিযোগ, বিনা নোটিসে বনকর্তারা এই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় জঙ্গল দেখার ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন পর্যটকরাই। বনকর্তাদের অবশ্য যুক্তি, চিলাপাতা যে হেতু জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের অধীনে পড়ে, তাই সেখানেও যে একই নিয়ম বলবৎ হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।যত দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে পর্যটকদের সংখ্যা। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে লজ বা হোম স্টেও।
চিলাপাতা ইকো ট্যুরিজম সোসাইটি সূত্রের খবর, বছর দশেক আগেও চিলাপাতায় জঙ্গলের ধারে একটি মাত্র লজ ছিল। কিন্তু গত এক দশকে জঙ্গল দেখার নেশায় সেখানে পর্যটকের সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন লজ ও হোম স্টে। এই মুহূর্তে চিলাপাতায় জঙ্গলের কাছে ৬টি বেসরকারি লজ ও ১৪টি হোম স্টে রয়েছে। আরও একটি লজ ও চারটি হোম স্টে তৈরি হচ্ছে। জঙ্গল বন্ধের তিন মাস সময় বাদ দিলে বছরের বাকি বেশিরভাগ সময়ই সেগুলি পর্যটকদের ভিড়ে ভরে থাকছে। এ বছরই যার ব্যাতিক্রম হয়নি।
কিন্তু চিলাপাতার পর্যটন ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এত দিন চিলাপাতায় সপ্তাহে সাত দিনই কার সাফারির সুযোগ পেতেন পর্যটকরা। কিন্তু এ বারে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে জঙ্গল খোলার পরে প্রতি বৃহস্পতিবার করে চিলাপাতায় যে জঙ্গল সাফারি হত, তা বন্ধ রাখে বন দফতর। ফলে বৃহস্পতিবার চিলাপাতায় থাকা পর্যটকদের দিনভর কার্যত লজ বা হোম স্টে-তে বসে সময় কাটাতে হচ্ছে বলে দাবি। চিলাপাতা ইকো ট্যুরিজম সোসাইটির সভাপতি গণেশকুমার শার অভিযোগ, বাইরের পর্যটকরা, বিশেষ করে কলকাতার দিকের লোকেরা এটাই জানেন যে, চিলাপাতাতে রোজই কার সাফারি হয়। সেই অনুযায়ী তাঁরা পরিকল্পনা করে চিলাপাতা ঘুরতে আসেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার এই সাফারি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই দিন যাঁরা এখানে থাকছেন বা যাঁরা অন্য জায়গা থেকে আগাম পরিকল্পনা করে আসছেন, সকলেই বিপাকে পড়ছেন। সোস্যাইটির আহ্বায়ক বিমল রাভার অভিযোগ, বৃহস্পতিবার করে যে চিলাপাতায় কার সাফারি বন্ধ থাকবে সে ব্যাপারে বন দফতরের তরফে আগাম কোনও নোটিসও দেওয়া হয়নি।
তবে জলদাপাড়ার ডিএফও কুমার বিমলের দাবি, নিয়ম অনুযায়ী সব জাতীয় উদ্যানই সপ্তাহে একদিন বন্ধ থাকে।
এসব শুনে আমাদের মনে হল, বনদপ্তর আরেকটু সজাগ হওয়া উচিত এই বিষয়টা নিয়ে। তবে চিরসবুজ সুন্দরী চিলাপাতার অমোখ রূপে মুগ্ধ হয়ে, আমরা হাসিমারার হোটেলে ফিরে এলাম।
(মৌমিতা ভাওয়াল দাস)