অনুভূতি

” এই ওষুধটা নে, মনে করে খাবি কিন্তু। এটা তোর মাথা ব্যাথার জন্য” উদ্বিগ্ন স্বরে ঊষসী সমীরণকে বলে।

সমীরণ ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে অধৈর্য স্বরে বলে ওঠে,

” উফ্ হ্যাঁ রে হ্যাঁ। মা ঊষসী আপনার সবকথা মনে আছে সব শুনব” বলে সে ট্রেনের জানালা দিয়ে উঁকি মারে… না, কই সঞ্জনা তো এখনও এল না, এদিকে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেল যে। ভাবতে ভাবতেই ট্রেন ছাড়ার বাঁশি দেয়। সঞ্জনাকে ফোন করবে কী না ভাবতে ভাবতে সমীরণ আবার বাইরের দিকে দেখে। দূর থেকে সঞ্জনার কালো শার্ট টা নজরে আসতেই সমীরণ হাত নেড়ে চেঁচিয়ে ওঠে,

” ওয়ে সঞ্জনা, এদিকে রে তাড়াতাড়ি আয়” সঞ্জনা দৌড়তে দৌড়তে এসে ট্রেনে উঠে পড়ে।

ঊষসী আর দেরি না করে দুজনকে বলে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে। নামার আগে আবার সে সমীরণকে বলে,

” মাথা ব্যাথার ওষুধটা মনে করে..”

সমীরণ তার কথাটা শেষ করতে না দিয়ে তাকে টাটা জানিয়ে সঞ্জনার পাশে গিয়ে বসে, এসব ঊষসী ট্রেনের বাইরে থেকে দেখতে পায়। সে হালকা মুচকি হাসে আর ধীর পায়ে স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে যায়।

সমীরণ আর ঊষসীর কলেজে আলাপ। বন্ধুমহলে পড়াকু বলে পরিচিত ঊষসীর প্রথম নজরে ওই হল্লাবাজ সমীরণকে মোটেই ভালোলাগেনি। তারপর ধীরে ধীরে কথাবার্তা শুরু হয়ে এখন তারা বেস্টির তকমা পেয়েছে। ইদানীং ঊষসী লক্ষ্য করে সমীরণ যেন সঞ্জনার দিকে একটু বেশিই আসক্ত হয়ে পড়ছে। পার্টি, ইউনিভার্সিটি থেকে শুরু করে নানান কফিশপে দুজনের একসাথে ছবি। ব্যাপারটা ঊষসীর মোটেই ভালোলাগেনি আবার এই না ভালোলাগার কারণটাও সে বুঝে ওঠে না।

আজ সমীরণ আর সঞ্জনা পাঁচদিনের জন্য মুর্শিদাবাদ ঘুরতে গেল। ঠিক ঘোরা নয় বলা ভালো এক্সকারশন্, ঊষসীর ইচ্ছা থাকলেও তার দাদু হঠাৎ মারা যাওয়াতে সেটা সম্ভব নয় আর। আজ কেন জানিনা তার মনটা খুশি খুশি লাগছিল যখন সঞ্জনার দেরি হচ্ছিল। কী যে হচ্ছে তার।

ঊষসী চলতে চলতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে, সজোরে মাথাটা ঝাঁকিয়ে নেয় একবার যেন এলোমেলো ভাবনা গুলোকে সে বশে আনতে পারছে না। খানিকক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর সে আবার হাঁটতে শুরু করে।

তাদের বাড়ি যাবার পথে একটা ছোট্ট পার্ক আছে। সচরাচর ঊষসী সেখানে যায় না, আজ যে কেমন ভাবে হেঁচকা টানে সে সেখানে উপস্থিত হয়।

পার্কটা আপাতত ফাঁকা। শেষ বিকেলের রোদটা যেন চারদিক আলো করে আছে। আসলে শীতের বেলা, তাই রোদে বেশি জোর নেই, ঊষসীর কীরকম ঠান্ডা ঠান্ডা লাগতে লাগল। লোকজন যেন হঠাৎ করে কম্বলের সাগরে ডুব দিয়েছে, ঘর থেকে আর বেরোয় না তারা।

পার্কের ওদিকটাতে কিছু বাউল এসে জড়ো হয়েছে। এই শীতের মরসুমে চারপাশে কতকিছু উৎসব ঘটে হয়তো এরাও এসেছে তাই জন্যে। বাউল লোকগুলোর গায়ে গেরুয়া রঙের জামা, মাথায় গেরুয়া রঙের ফেট্টি বাঁধা। নারী, পুরুষ সবাই গোল করে ঘিরে বসে আছে একজায়গাতে আর তাদের মাঝে আগুন জ্বলছে ধিকিধিকি করে। তাদের সবার হাতেই বাউল যন্ত্র মনে হয় এখনই গান শুরু হবে।

ঊষসী কোনদিন গান শোনেনি এদের তাই কৌতুহলবশত সে তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

একজন বয়স্ক দেখে বাউলের লোক উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে নমস্কার করে হাত জোড় করে গান শুরু করে।

“…চাতকপ্রায় অহর্নিশি চেয়ে আছে কালো শশী,

হব বলে চরণ দাসী …”

একী গানটা শুনতে শুনতেই কখন যেন আনমনে ঊষসী কেঁদে ফেলে অনেকটা, তার দু চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমেছে তখন।

” … ও তা হয়না কপাল গুণে, আমার মনের মানুষের সনে, ও আমার মনের মানুষেরও সনে।

মিলন হবে কতদিনে, হো মিলন হবে কতদিনে,

আমার মনের মানুষেরও সনে, হো আমার মনের মানুষেরও সনে…”

দুহাতে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করে ঊষসী। সে বুঝেছে তার কী হয়েছে… কখন কবে কীভাবে সে জানেনা তবে এই মুহূর্ত থেকে সে সমীরণকে খুব ভালোবাসে। উপলব্ধি টা আসার সঙ্গে সঙ্গে একধরনের নিঃসঙ্গতা তাকে ঘিরে ধরে। সমীরণ তো সঞ্জনাকে চায়, উষসী যদি নিজের মনের কথা জানাতে যায় তাহলে হয়তো বন্ধুত্বটাই ভেঙে যাবে। হায় ভগবান, কেন এরকম অনুভূতি দিলে আমাকে, কাঁদতে কাঁদতে ঊষসী ভাবে। বাউল গান তখনও বেজে চলেছে, ঊষসীর প্রতিটা অনুভূতি কে ব্যক্ত করছে সে।

“… ওইরূপ যখন স্মরণ হয়,  থাকে না লোক লজ্জার ভয়,

লালন ফকির ভেবে বলে সদাই,

ও প্রেম যেই করে সে জানে…”

গানের কথা গুলো কানে যেতেই ঊষসী সোজা হয়ে বসে আবার। সত্যি তো, এত ভয়, সংকোচ, মনে দ্বিধা কেন তার? ভালোবাসা তো ভালোবাসাই হয়। নাইবা পাওয়া গেল, নাইবা বলা হল তাকে এই যে সমীরণ সঞ্জনার সাথে এত খুশি এও কী কম প্রাপ্তি নাকি? দেনাপাওনা তো ব্যাবসাতে হয়, এ তো ভালোবাসা।

কথাটা মনে হতেই ঊষসী উঠে দাঁড়ায়, চারাপাশটা একবার তাকিয়ে দেখে, সূর্যটা কখন যেন ঘরে চলে গেছে। বাউলের গানটাও শেষ পথে এবার ঊষসীকেও বাড়ী ফিরতে হবে। আসলে ভালোবাসার উগ্রতম প্রকাশে ভালোবাসাটা মরে যায়, তার অন্তর্হিত বাস, ভালোবাসাকে প্রকট করে এই উপলব্ধি ঊষসীর মনকে অনেক বেশি মুক্ত করে দিয়েছে।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *