ডিজিটাল লিটারেসি: সময়ের প্রয়োজন

অনলাইন ক্লাস চলছে। শিক্ষক নিজের সাধ্যমত চেষ্টা করছেন যাতে তাঁর ছাত্ররা একটু হলেও পড়াটা শোনে। কিন্তু ছাত্ররা অবিরাম চেঁচিয়ে যাচ্ছে, গালাগাল অব্দি করছে। কিছু ছাত্র বলছে যে ওদের মিউট করে দিতে। কিন্তু ক্লাসরুমে তিনি শাসন করলেও, বর্তমানে তাঁকে অসহায় করে দিয়েছে এই নতুন প্রযুক্তি।

চারিদিকে কড়া লকডাউন চলছে। মুম্বাই এর বান্দ্রা স্টেশন এ ধীরে ধীরে হাজারের থেকেও বেশি পরিযায়ী শ্রমিকদের ভিড় জড়ো হল। পুলিশ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে যে, তারা সবাই বাড়ি যাওয়ার জন্য ট্রেন ধরতে এসেছে। কিন্তু সারাদেশে কোনো ট্রেনেই চলছে না, আর চললেও ওই স্টেশন হতে মহারাষ্ট্র এর বাইরে কোনো ট্রেন এই যায়না। কোথায় খবর পেয়েছেন জানতে চাইলে সবারই একই উত্তর যে কেউই প্রত্যক্ষ খবর পাননি, সবাই ফোন বা হোয়াটস্যাপের মাধ্যমে খবর পেয়েছেন।

বেঙ্গালুরু এর এক যুবক একখান কুর্তা অর্ডার দিয়েছিলেন। কিন্তু কুর্তাখানা পছন্দ না হওয়াতে তিনি সেই কুর্তার রিফান্ড এর জন্য কাস্টমার কেয়ার কে ফোন করেন। কাস্টমার কেয়ার তাঁকে একখান লিংক পাঠিয়ে সেখানে তার ব্যাংক ইনফরমেশন দিতে বলেন। লিংক এ ইনফরমেশন দেওয়ার পর  তিনি দেখেন যে তার রিফান্ড তো দূর অস্ত, তার  বদলে আরো তিরিশ হাজার টাকা কাটা গেছে।

লকডাউন চলাকালীন বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা। একটি অনলাইনে দুর্ব্যবহার, একটি ভুয়ো খবর, একটি অনলাইন ঠগ এর। প্রত্যক্ষ দৃষ্টি তে ঘটনাগুলো ভিন্ন মনে হলেও, যদি গভীর ভাবে দেখেন তো ঘটনা গুলোর একসূত্রে গাঁথা যায়। সূত্ৰ এই যে তিনটি ঘটনায় যিনি শিকার হয়েছেন তাঁরা অপরাধীদের সাথে অনলাইন মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন। তিনজনেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা ভিন্ন হলেও তারা সবাই প্রযুক্তিগত জ্ঞানের ঘাটতির জন্য আক্রান্ত হয়েছেন। তো এই ঘাটতি মেটানোর উপায় কি? উপায় হল ডিজিটাল লিটারেসি।

এখন প্রশ্ন আসে ডিজিটাল লিটারেসি কী? আর

কেনই বা ডিজিটাল লিটারেসির অভাবে কোনো শিক্ষক অপমানিত হচ্ছেন বা একসাথে এতজন মানুষ ভুয়ো খবরের শিকারী হচ্ছেন বা কেউ এখনো এত সচেতনতা ছড়ানোর পরেও অনলাইনে প্রতারিত হচ্ছেন। প্রশ্নের উত্তর করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় ডিজিটাল লিটারেসি কী? এককথায় বললে বোঝায় ডিজিটাল প্রযুক্তিকে কার্যকর ভাবে ব্যাবহার করতে জানা এবং তার প্রভাব সম্বন্ধে অবগত থাকা। তাহলে অসুবিধা কোথায়? এখন তো প্রায় আট থেকে আশি সবাই দিব্যি ফোন করছেন, ইন্টারনেটে খবর পড়ছেন, আর্থিক লেনদেন করছেন। ব্যবহার করতে এর থেকে বেশি কি আর বিদ্যা-বুদ্ধি প্রয়োজন?! এই খানেই মূল সমস্যাটা লুকিয়ে। আমরা হয়ত নিজেদের সাথেসাথে আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রজন্ম এর লোকেদেরও হাতে আশ্চর্য্য প্রদীপ(মূলত মোবাইল ফোন) তুলে দিয়েছি ঠিকই, বর  চাইবার পদ্ধতিটাও বুঝিয়ে দিয়েছি; কিন্তু এটা  উপলব্ধি করতে ও করাতে পারিনি যে কেমন ভাবে আর কীই বা বর চাইলে আমাদের সঠিক মর্মে লাভ হবে।

 

তাই এই প্রসঙ্গে কথাটা বলা চলে যে আমরা সবাই ডিজিটালি প্রশিক্ষিত; শিক্ষিত খুব কম লোকই। এই প্রশিক্ষিত আর শিক্ষিত এর তফাৎ টা হল যে প্রশিক্ষিত শুধুমাত্র ব্যবহার করতে জানে, কিন্তু শিক্ষিত কেন কীভাবে ব্যবহার করব, ব্যবহার করলে লাভ-ক্ষতি ভিন্নও আরো কি কি হতে পারে তা নিয়ে অবগত। ভারতের এই বিশাল সংখ্যক ডিজিটালি প্রশিক্ষিত অথবা স্কিল্ড লোকেদের(তথ্যানুসারে ভারতে প্রত্যহ ইন্টারনেট ব্যহারকারী ৬০০ মিলিয়নের চেয়েও বেশি; ২০১৯) প্রাথমিক ডিজিটাল শিক্ষার অভাবই আমাদের কে জ্ঞানে অজ্ঞানে বৃহত্তর সমস্যার দিকে ঠেলছে।

বৃহত্তর সমস্যা কিরকম? যদি তথ্য দেখেন তো জানা যায় যে লকডাউনে দেশের লোক গড়ে ৫ ঘণ্টা ২০ মিনিট অনলাইন ভিডিও দেখছে(তথ্য:- Livemint)। যদি তার সঙ্গে ইন্টারনেট সার্ফিং, সোশ্যাল মিডিয়া এর টাইম জুড়ে দেন তো সেটা অন্তত হলেও ৮ ঘণ্টা তো যাবেই। তবুও আপনি যদি বয়সের অনুসারে বিভক্ত করে এই সময়টা কমানো বাড়ানো করেন তবুও যদি কোনো সাধারণ ভারতীয় ৬ ঘন্টার আশেপাশে ডিজিটালি কানেক্টেড। এরপর ভাবুন একটা মানুষ যার ওপর ভিত্তি করে দিনের এক চতুর্থাংশ সময় ব্যয় করে, সেই অস্তিত্ব টা তার কর্ম, ভাবনাচিন্তা, জীবনযাপন এর প্রভাব না ফেলাটা আশাতীত। আমরা যথেষ্ট ভাবে সেই প্রভাব তা লক্ষ্য করতে পারছি। তাহলে এবার প্রশ্নটা দাঁড়ায় যে আপনি একুশ শতকে বসে আপনার জীবনদর্শন ঠিক করার একটা অন্যতম নির্নায়কের নিয়ে ন্যুনতম শিক্ষা টা কি আছে আপনার? যদি উত্তর ‘না’ হয়, তবে আপনি জাতি-ধর্ম-বয়স-লিঙ্গ নির্বিশেষে ডিজিটাল লিটারেসি বিষয়ের হাতে-খড়ির ছাত্র। এরপর আপনার প্রশ্ন জাগবে যে আপনি ডিজিটাল লিটারেসি নিয়ে কোথায়, কিভাবে শিখবেন।

ডিজিটাল লিটারেসিকে শিক্ষাবিদ নিজের ধারণানুসারে ভাগ করে থাকেন।

ডিজিটাল লিটারেসি কে সাধারণত বিভিন্ন শিক্ষাবিদেরা নিজ নিজ হিসেবে সংজ্ঞা ও ভাগ করেছেন। কিন্তু একদম নতুন পরিচয় এর স্বার্থে বলতে গেলে ডিজিটাল লিটারেসিকে চারখানা বুনিয়াদি ভাগ দর্শানো যায়। যা হল-

  • ১. Internet Safety:- ইন্টারনেট সেফটি হল ইন্টারনেট এ আপনার টাকার লেনদেন থেকে শুরু করে আপনার নিজস্ব ছবির আদানপ্রদান সুরক্ষিত ভাবে করার শিক্ষা। ইন্টারনেট আপনার পক্ষে সঠিক সুরক্ষিত সাইট নির্বাচন, আপনার নিজের তথ্যকে রক্ষা করা এবং ইন্টারনেটের বিভিন্ন হানিকারক সাইট থেকে দূরে থাকা এবং সেই সাইট সম্বন্ধে অন্যকেও সাবধানতা প্রচার করতে শেখানো এই ভাগের মূল লক্ষ্য।
  • ২. Cyberbullying:-  সাইবারবুলিইং এর নিয়ে জ্ঞান অর্থাৎ লিখিত, অডিও এবং ভিডিও তিন মাধ্যমে মানসিকক্ষতিকারক  ব্যবহার এবং আলোচনাকে চিহ্নিত ও বন্ধ করা। সবার মতামতকে গ্রহণ, গঠনমূলকতর্ক এবং অনলাইন দুর্ব্যবহার থেকে বিরত করে এর মূল লক্ষ্য।
  • ৩. Digital Footprint:- ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট নিয়ে জ্ঞান হল এই ধারণা টা তৈরি করা যে অনলাইন দুনিয়ায় আপনার প্রত্যেকটি ক্রিয়াকলাপ রেকর্ড করা হচ্ছে।আপনি ডিজিটাল অর্থাৎ ইন্টারনেট মাধ্যমে যাই করবেন তা কোনোদিনও মুছে ফেলা সম্ভব নয়। তাই আপনার উচিত প্রত্যেকটি পদক্ষেপ নিয়ে দায়িত্বশীল হওয়া।
  • ৪. Ethics of Using Online Resources:- অনলাইন রিসোর্স এর এথিক্স বলতে বোঝায় যে অনলাইন তথ্য কে সঠিক ভাবে বিচার বিবেচনা করে গ্রহণ এবং বিতরণ করা। তার সাথেই যদি আপনি যদি অন্য কারো হতে সেই তথ্য নিয়ে থাকেন তাকে যোগ্য কৃতিত্ব দেওয়া।

এই চারটি মূল অংশ ভিতরেও আরো অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অংশ আছে। বিভিন্ন শিক্ষাবিদ যা নিজের মত করে ব্যাখ্যা টা বাড়িয়েছেন।

সরকারি প্রচেষ্টা দেখলে জানা যায় যে ২০১৫ থেকে ২০২০ অব্দি ডিজিটাল ইন্ডিয়া উদ্যোগের অন্তর্গত প্রধানমন্ত্রী গ্রাম্য ডিজিটাল সাক্ষরতা অভিযান(PMGDisha), ডিজিটাল ইন্ডিয়া সাক্ষরতা অভিযান(DISHA), এবং ন্যাশনাল ডিজিটাল লিটারেসি মিশন(NDLM) নিয়ে মোট তিনটি কর্মসূচি চলছে। কিন্তু তার লক্ষ্যমাত্রা তো দূর অস্ত, দেশের দুই শতাংশ লোককে অব্দি এই কর্মসূচি প্রভাবিত করতে ব্যার্থ এখনো অব্দি(তথ্য:-TOI)। সেখানে শেষ পাওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী যেখানে প্রকল্পের শুরুর সময়ে ডিজিটালি স্বাক্ষরতার মাপকাঠি এ অনলাইন অর্থ লেনদেনে সক্ষম, অনলাইন জগতের নিয়ে দরকারি বিধি নিষেধ বোঝার ক্ষমতার মত গুরুত্বপূর্ন বিষয় ছিল, সেখানে আজ যেকোনো ব্যক্তি ফোন, ল্যাপটপ চালাতে পারলেই সেই ডিজিটালি স্বাক্ষর হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। আখেরে যার ফলে আমাদের মূল লক্ষ্য থেকে আমরা সরে যাচ্ছি, এবং সরকারি খাতা ভরানোর দায়ে দেশের একটা বড় অংশকে অসুরক্ষিত রেখে দিচ্ছি।

পড়ুন:- নেপোটিজম, কর্পোরেট এবং বৃহত্তর ষড়যন্ত্র

এমতবস্থায় আমাদের প্রয়োজন চেষ্টা। চেষ্টা করা যাতে বাচ্চা থেকে বুড়ো ডিজিটালি প্রভাবিত সবাইকে ডিজিটাল লিটারেসির গুরুত্ব বোঝানো এবং ডিজিটালি শিক্ষিত করা। এই অনলাইনের বিভিন্ন সহজলভ্য লিখিত,অডিও এবং ভিডিও এর মাধ্যমে নিজেকে তথা সবাইকে শিক্ষিত করে তোলা। যাতে আমরা অন্তত নিজেকে হলেও কোনো অনলাইন অপ্রীতিকর ঘটনার অংশ অথবা শিকার না হতে পারি। আশার কথা যে NCERT এবং গুগল মিলে ডিজিটাল লিটারেসি এবং ইন্টারনেট সেফটির ওপর অধ্যায় পাঠক্রমে যুক্ত করতে চলেছে। পাঠক্রমে আসুক না আসুক এই ডিজিটাল যুগে আমদের শিক্ষা থেমে থাকে না। ইউটিউবেই ডিজিটাল লিটারেসি ভিডিও এর ছড়াছড়ি যারা সহজ ভাষায় আপনাকে বুঝিয়ে দেবে প্রত্যেকটি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ব্যাপার। নিচে একখান সহজ এবং সঠিক ভিডিও লেকচার সিরিজের লিংক দিলাম।

তাই একে অপরকে ডিজিটালি শিক্ষিত করুন এবং গড়ে তুলুন দেশের উন্নত নাগরিক।

Facebook Comments Box
Staff Writer

Editorial Team of LaughaLaughi

Recent Posts

Kolkata to Witness B Praak’s Mesmerizing Performance at ‘Kolkata Odyssey’ on October 20th

The vibrant city of Kolkata is set to host an extraordinary musical event as renowned Indian music…

4 months ago

Celebrating Friendship and Togetherness with Pujo Pujo Gondho

In a heartwarming ode to friendship and the unifying spirit of Pujo, SVF Brands has…

4 months ago

Frustration Turned To Calmness, Thanks To These Websites

The year 2024 has not been what I had planned so far. Everything went downhill.…

5 months ago

SVF Music Unveils April Edition of “Banglar Gaan Indies”

Following the resounding success of the inaugural edition, SVF Musicproudly announces the arrival of the…

10 months ago

Mimi Chakraborty and Nabila to Star Alongside Shakib Khan in ‘Toofan’

Amidst ongoing speculations regarding the leading lady opposite Shakib Khan in the upcoming film 'Toofan',…

11 months ago

Why Does a Rich Chicago Law Firm Keep Suing Indian Tribes?

This article originally appeared in DC Journal: https://dcjournal.com/why-does-a-rich-chicago-law-firm-keep-suing-indian-tribes/ Why does a deep-pockets Chicago law firm keep…

1 year ago