অধরাই রয়ে গেলেন “মিতিন মাসি”

সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র লেখিকা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের অকাল প্রয়ানে আমরা সকলেই বাকরুদ্ধ | এই মহান প্রতিভার জন্ম ১০ই জানুয়ারী ১৯৫০ বিহারের ভাগলপুরে | ছোট থেকেই সাহিত্যের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ ছিল তাঁর | তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে স্নাতক হন | তাঁরপর সংসারিক জীবনে আবদ্ধ হয়ে সাহিত্য থেকে কিছুটা বিচ্ছেদ ঘটে তাঁর | কিন্তু সত্তরের দশকে পুনরায় কলম ধরেন তিনি | আশির দশকে তিনি ছোট গল্প থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে উপন্যাস রচনায় বেশি মনোনিবেশ করেন | সেইসময় তিনি তাঁর বিখ্যাত রচনা “কাঁচের দেওয়াল” র জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিলেন |

suchitra1

সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি তিনি কর্মজীবনেও নানা জটিলতাঁর সম্মুখীন হন, কিন্তু অবশেষে সব কিছু অতিক্রম করে শুধুমাত্র সাহিত্তচর্চাকেই এক ও অদ্বিতীয় পেশা বলে গ্রহণ করেন |  তাঁর গল্প বা উপন্যাসের মূল বিষয় সামাজিক টানাপোড়েন | অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় গল্পের বিষয়-বস্তুকে তিনি পাঠক এর কাছে পৌঁছে দিতেন | তাঁর অসাধারণ গল্প পরিবেশন ও বাচনভঙ্গি সহজেই সকল লেখক লেখিকার থেকে তাকে পৃথক করে অনেক উচ্চস্থানে পৌঁছতে সাহায্য করেছে | তিনি সাধারনতঃ মধ্যবিত্তদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন, বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে নৈতিক অবক্ষয় ইত্যাদি বিষয়কে বেশি প্রাধান্য দিতেন | নারীবাদী ছিলেন বললে ভুল হবে তবে তাঁর বেশ কিছু রচনায় মেয়েদের নানান সামাজিক সমস্যা ও ব্যক্তিগত জীবনের বাস্তব সমস্যার কথা উঠে এসেছে |

শেষ কয়েক বছর ধরে তিনি ২০ টির বেশি উপন্যাস এবং অসংখ্য ছোট গল্প রচনা করেন | বিভিন্ন পত্রিকা তে সেগুলি প্রকাশিত ও হয়েছে | তাঁর বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য উপন্যাস – “কাছের মানুষ”, “দহন”, “কাঁচের দেওয়াল”, “হেমন্তের পাখি” ইত্যাদি | তাঁর বিখ্যাত রচনা “দহন” এর উপরে বিখ্যাত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ – এর পরিচালনায়ে একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মিত হয় (১৯৯৭ সালে) | তাঁর এই কর্মপ্রতিভার জন্য তিনি নানা পুরস্কার পেয়েছেন |

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “ভুবন মোহিনী মেডেল” (২০০৮ সাল), দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “কাঁথা”, “তারকেশ্বর” (২০০০ সাল), “সাহিত্য সেতু” (২০০৮ সাল), বেঙ্গালুরু থেকে “নন্জাগুডু থিরুমালাম্বা” জাতীয় পুরস্কার, “দ্বিজেন্দ্রলাল অ্যাওয়ার্ড” (২০০১ সাল), ভাগলপুর থেকে শরৎপুরস্কার অ্যাওয়ার্ড (২০০২ সাল) |এছাড়াও “ভারত নির্মান অ্যাওয়ার্ড”, “সাহিত্য সেতু অ্যাওয়ার্ড”, “দিনেশচন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার” (২০১৫ সাল) | 

suchitra2

তাঁর সব থেকে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস “মিতিন মাসি” | তিনি বর্তমান প্রজন্মের কাছে এই নামেই বেশি পরিচিত | সেই মিতিন মাসির এই ভাবেই আকস্মিক চলে যাওয়া আমাদের কাছে এখনো বিশ্বাস যোগ্য হয়ে ওঠেনি | ২০১৪ সালে মার্চ মাসে নৈহাটি তে আনন্দ পাবলিশার্স এর বই এর দোকানে উদ্বোধন করতে এসে ডান হাত ভেঙ্গে যায় তাঁর | তারপর নানা চিকিৎসার পরও তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হননি | সেই যন্ত্রণা তাঁর লেখনীকে কোনো ভাবে আটকে রাখতে পারেনি | তাঁর মানসিক দৃঢ়তা তাঁকে অনেকাংশ এগিয়ে দিয়েছিল এবং তিনি বলেছিলেন, “অপারেশন এর পরে বাড়ি ফিরে ১৫-২০ বিশ্রাম নিয়েছিলাম | তারপর আবার লেখা শুরু করি | ” এছাড়াও বলেছিলেন, “শারদীয়ার লেখা কোনো বছর বাদ দিইনি, আর মিতিন মাসিকে তো ব্রেক হতে দেবই না | ” কিন্তু মিতিন মাসির সৃষ্টিকর্তার প্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র যদিও ব্যোমকেশ বক্সী | এই মহান প্রতিভা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দক্ষিন কলকাতার ঢাকুরিয়া অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন | হঠাৎই ১২ই   মে, ২০১৫ তে রাত ১০টা ৪৫ মিনিট এ তাঁর নিজস্ব বাড়িতে হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে এই মহিয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে | তবে সৃষ্টির মাধ্যম এই শ্রষ্ঠা আমাদের মনের মনিকোঠায় চিরকাল বেঁচে থাকবে | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “শেষ হয়েও হইল না শেষ” | এক্ষেত্রেও অন্যথা হবে না |

আমরা ওনার আত্ম্যার শান্তি কামনা করি |     

Content writing: Sabarni Ghosh
Picture Courtesy :suryasekhar.com, aajkal.in, facebook.com
Original Copyright © 2014 LaughaLaughi.com. All Rights Reserved

 

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *