একটি ওড়নার আত্মকথা
আলনাটাতে খুব ধূলো জমেছে। সারা শরীর কিচকিচ করছে ধূলোতে। কবে যে একটু স্নান করতে পারবো! আমি তো আবার মালকিন স্নান না করিয়ে দিলে যে নিজে স্নান করবো তারও উপায় নেই। একটা সামান্য ওড়নার কি আর কোনো সাধ আহ্লাদ থাকতে আছে? অবশ্য না… আমার মালকিন যথেষ্ট ভালোবাসে আমায়। এখনো মনে আছে যেদিন ও প্রথম দেখেছিল আমাকে সেই দিনটার কথা। দোকানের তাকে পরে ছিলাম ভাঁজ হওয়া অবস্থায়। হাল্কা দাম্ভিক চালে মিষ্টি দেখতে মেয়েটা যখন দোকানে ঢুকেছিলো আরও দুটো সমবয়সী মেয়েকে নিয়ে, দোকানদার যাবতীয় ভালো দরের আর ভালো মানের জিনিসপত্র নিয়ে হাজির হয়েছিল কাউন্টারে। বাকি দুজন জিনিসপত্রের উপর হামলে পড়লেও মেয়েটা ছিলো আনমনা। কিছুই যেন পছন্দসই নয় তার… যেন সে কোনো অন্য জগতের বাসিন্দা। চোখ দুটো মাঝে মাঝেই হারিয়ে যাচ্ছিলো কাঁচের সুইং ডোরের ওপাশের ধূসর আকাশে। তখনই বুঝেছিলাম, দোকানের প্রতিদিনের কাস্টোমারদের থেকে সে যেন একদমই আলাদা। সেদিন হঠাৎ করেই তার চোখ পরেছিল আমার উপর। তারপর যা হয় আর কি… প্যাকিং,বিলিং, হাতবদল এবং আমার বাক্সবন্দি হয়ে মালকিনের বাড়িতে প্রবেশ। কম বকা কি খেয়েছিল সেদিন মেয়েটা মায়ের কাছে! ” সবাই কি সুন্দর সুন্দর শাড়ি চুরিদার কিনলো তিতিদিদির বিয়েতে পরবে বলে। তুই খালি কিনলি একটা ওড়না? বিয়ের দিন কি আবার one piece পরে ধিঙিপনা করবি?” সে শুধু আমার সারা শরীরে হাত বুলিয়ে বলেছিল- “কিন্তু এটা ভেলভেট রেড তো!” ব্যাস! এভাবেই আমার মালকিন পেলো একটা ভেলভেট রেড ওড়না, আর আমি পেলাম একটা খামখেয়ালি মালকিন।
তারপর থেকে কিছু বছর তো আমি মালকিনের ছায়াসঙ্গী! পথে-ঘাটে, গঙ্গার পাড়ে বসে দুষ্টু-মিষ্টি খুনশুটিতে, বন্ধুর জন্য আয়োজন করা সারপ্রাইজ জন্মদিনের ঝলমলে সকালে, পড়ন্ত বিকেলে কলেজের গাঁজার ঠেকে, উদ্দাম বাইক রাইডে। মন খারাপের বিকেলগুলোতে একলা ছাদের কোণায় টুকরো টুকরো সিগারেটের ছাইতে যেমন আমার শরীর ঢেকে গেছে, দমবন্ধ রাতে চোখের জলের দাগও লেগেছে শরীরে তেমনি।
কিছুদিন হল একটা নতুন বাড়িতে উঠে এসেছি আমরা। আমার খুব ভালো লাগছে এখানে এসে। যদিও একটু চুপচাপ এ বাড়িটা। মালকিনের সেই অঢেল ছেলে বন্ধুর দলবল আজকাল আর আসে না এ বাড়িতে। একদিনই এসেছিল ওই লম্বা চুলো ছেলেটা যার পিঠে একটা গীটার ঝোলে সবসময়। শুনলাম তাকে মালকিন বলেছে ” রাজ, কিছু মনে করিস না… কিন্তু আমরা প্লিজ বাইরেই দেখা করি? আমি চাই না আমার ব্যাপারে বলা কথা গুলো কে কেউ সত্যি ভাবার চান্স ও পাক।” ছেলেটা একটু হেসে মালকিনকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল… “অলরাইট ম্যাডাম, আর তো জাস্ট কয়েকটা বছর! তারপর তো তুই পার্মানেন্ট ভাবেই আমার বাড়িতে চলে আসছিস! ঈসসসস!!! সর তো!! টি শাট টা ভেজাবি এবার… ছিঁচকাঁদুনী কোথাকার!” সেদিন রাতে… মালকিন সারারাত আকাশ দেখেছিলো আমায় গায়ে জড়িয়ে। মুখে ছিলো এক অনাবিল হাসি। আমিও মনে মনে রাজকে একটা thank you বলে ফেলেছিলাম সেদিন।
সেদিন কথা হচ্ছিলো আমার পাশে ঝোলা রাস্টি কালারের সাথে। তার মুখেই শুনলাম- মালকিন আমাদের আজকাল অনেক অটোগ্রাফ দিচ্ছে। হবে না! তার প্রথম সিনেমা হিট হল যে! সেই রাতটা এখনো মনে আছে আমার- যেদিন সেই অভিমানী মেয়েটা বাবার বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল- “আমি creative person। নিজের স্বপ্নগুলো আমার খুব প্রিয়। সেগুলো শিকেতে তুলে দিয়ে কোনো ফালতু desk job করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা তোমার পায়ে আমি ঢালতে পারবো না। I am busy born, not busy dying”।
“যা যা- দেখবো কটা producer এর সাথে শোওয়ার পর একটা B graded সিনেমা বানাতে পারিস”। কথাটা শুনে দুম করে সদর দরজাটা বন্ধ করে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল তখন ওর গলাতেই ঝুলছিলাম আমি। শীতের রাত হলেও বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম আপাদমস্তক। ঘুমহীন script writing এর রাত গুলো, ব্যস্ত শুটিং ডে, কম্পিউটারের সামনে বসে ক্লান্তিহীন চোখে এডিটিং… সবকিছুতেই আমি সাক্ষী। না, কোনো প্রোডিউসারের নষ্ট হাত আমায় ওর গা থেকে ছাড়িয়ে ফেলে দেয়নি। হয়তো বা ভেবেছিল, কিন্তু কার ঘাড়ে কটা মাথা যে এই বদরাগী মেয়েটাকে ঘাঁটাবে!
ওই তো! মালকিন ঘরে ঢুকল গুন গুন করে গান ভাঁজতে ভাঁজতে। আমাকে কোলে তুলে নিয়েই চিৎকার- “ঈস! কত নোংরা হয়ে গেছিস! চল তোকে আজ নিজের হাতে স্নান করাই”। তারপর ঘর থেকে বেরোনোর আগে আমাকে গালে ঘষে পাগলী মেয়েটা বললো “তোর জন্যই তো আজ এত কিছু! তুই আমার lucky charm!” এখন ভীষণ খুশি আমি। বাকি সময়টুকু আমার আর ওর ব্যক্তিগত। কারন আর কেউ ওর কথা বুঝুক না বুঝুক, আমি বুঝি।