সেবার সবাই মিলে বেড়াতে গিয়েছিলাম বক্সা-জয়ন্তী। শহুরে যানজটের ধুলো-ধোঁয়াকে ফুৎকারে উড়িয়ে রেলগাড়িতে দুলতে দুলতে পৌঁছে গিয়েছিলাম একদম পাহাড়ের কোলে, “মহাকাল” যেখানে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় স্বয়ং উপস্থিত। সেখানে ছিলাম জয়ন্তী নদীর কাছে বনের মাঝে এক কাঠের বাড়িতে। ঘুম থেকে উঠে জানলা খুলতেই চোখে পড়ত খালি সবুজ সবুজ গাছ, আকাশ দেখার উপায় ছিল না সেথায় ওই কাঠের দুপল্লা খুলে।
সে যাই হোক, এবার কাঠের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নদীর চারপাশটা ঘোরার সময়। একদিন সকালবেলা চা খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম নদীর চারপাশটা ঘুরে দেখতে। হোটেল থেকে হাঁটাপথ ধরে জয়ন্তী নদীর কাছাকাছি যেতে চোখে পড়ল একটা ছোটখাটো মন্দির। মন্দিরে প্রণাম সেরে নদীর পাড় বরাবর যতদূর এগিয়েছি শুধু দেখেছি সাদা, অফ হোয়াইট বা হালকা নীল রঙের পাথর। নদীর কাছাকাছি গিয়ে দেখি জল যেন কাঁচের চেয়েও স্বচ্ছ, ভিতরে ছোট ছোট সাদা নুড়ি নজর এড়ালো না আমার। এদিকে সূর্যের দীপ্তি যত বাড়ছে ততই যেন জয়ন্তী অলঙ্কারে অলঙ্কারে রাজরানীর মতন সেজে উঠছে, ঝলসে দিচ্ছে আমাদের চোখ, কিন্তু নদীর জল তখনও ভিজে চুলের মতোই কোমল ও শীতল। তখনকার মতো তারপর ফিরে এলাম আবার নিজের অস্থায়ী ঠিকানায়।
পরেরদিন সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরিয়ে পড়লাম মহাকালের উদ্যেশ্যে। মহাকাল কি! পর্বত নাকি পাহাড়? নাকি অন্য কিছু দেখার আগে অবধি কিছুই জানতাম না! তবে এবার আর পায়ে হেঁটে না, গাড়ি করে জয়ন্তী নদীর পাড় বরাবর খানিকটা এগোলাম ড্রাইভারের পাশে বসে থাকা গাইডের নির্দেশমতো। ড্রাইভারকে একজায়গায় গাড়ি থামাতে বলে আমাদের নামার নির্দেশ দিলেন গাইড। আমরা নামলাম এবং তারপর থেকে শুরু হল আমাদের “মহাকাল” যাত্রা।
প্রথমে নদীকে আমরা কোমর জলে পায়ে হেঁটে পেরোলাম তারপর উঁচু নিচু রাস্তা ধরে এগোতে থাকলাম গাইডের দেখানো পথ ধরে। হাঁটতে হাঁটতে কোথাও পেয়েছি বড় বড় ঘাসের বন, কোথাও বা চোরকাঁটার ঝোপ, আর এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা হাতির বিষ্ঠা এটা প্রমাণ করে আমরা যে পথে চলেছি সেই পথে হাতির নিয়মিত যাতায়াত। যদিও সেটা দিনের বেলা ছিল তবু মাঝে মাঝে দূরের ঘন জঙ্গল থেকে ভেসে আসা কোনো বন্য পাখির রহস্যময়ী কণ্ঠস্বরে আমার মনে হচ্ছিল যেন গল্পে পড়া “চাঁদের পাহাড়” অভিযানে বেড়িয়েছি। যতদূর মনে পড়ে এভাবে আমরা চারবার ক্রস করেছি জয়ন্তীকে জলের তলায় থাকা নুড়িপাথরের আঘাত সয়ে কোথাও এক মানুষ জল নিয়ে কোথাও বা কোমর অবধি জল নিয়ে। গাইডের কথায় জানলাম এটা শরৎকাল তাই স্রোতস্বিনীর স্রোত কম, বর্ষাকালে তার রুদ্রমূর্তি দেখলে স্বয়ং শিবঠাকুরও ভয় পেতেন! তবে শরৎকাল হলেও জলের টান বেশ ভালোই, আমরা অনেকজন ছিলাম তাই হাত ধরাধরি করে চেন তৈরি করেছিলাম নিজেদের মধ্যে তারপর একে একে পার হয়েছি আস্তে আস্তে। এক এক জায়গায় নদীর স্রোত এত বেশি যে আমরা পার হতেই পারছিলাম না কোনোভাবে, সেই মুহূর্তে জলে ভেসে আসা একটা শক্তপোক্ত গাছের ডাল বাবা ধরে ফেলে আর তার পর থেকে ওই লাঠি ধরেই আমরা পারাপার করি।
এভাবে হাঁটতে হাঁটতে আসল জায়গায় পৌঁছাতে আমাদের ঘণ্টা দুয়েক সময় লেগে গেল। শেষবার নদী পেরিয়ে ওপাড়ে গিয়ে দেখি পাথুরে জমিতে একটা মই-এর মতো সিঁড়ি গাঁথা আছে। সেই সিঁড়ি বরাবর উপরে উঠতেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই স্থান যার জন্য সূর্যের সাথে আমাদের এই এতক্ষণের পথ হাঁটা। এতক্ষণ পরে মনের সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েও যেন বাকি থেকে গেল আরো একটি প্রশ্ন— যিনি গাইড করছিলন আমাদের তাঁকে এক পৃথিবী বিস্ময়ে তখন জিজ্ঞাসা করলাম, “এইখানে এই গুহার মুখে আবক্ষ জটাধারীকে স্থাপন করল কে? কেই বা তৈরি করেছে এই মূর্তিকে?” উত্তরে জানলাম পাথরের ফাটল বেয়ে গড়িয়ে আসা জল অন্য পাথরকে (শিবমূর্তি যে পাথরের) ক্ষয় করে তৈরি করেছে এমন এক অনন্য সৃষ্টি আর এই সৃষ্টিরই নাম “মহাকাল”। আমরাও দেখলম মহাদেবের মূর্তির চারপাশটা কেমন ভিজে আছে পাথরের ফাটল বেয়ে এক-ফোঁটা দু-ফোঁটা করে গড়িয়ে আসা জলে। এমনসময় শিবমূর্তির পাশে রাখা কয়েকটা ধুপ ধরিয়ে দিতে দিতে অঙ্গুলি নির্দেশ করে গাইড দেখালেন জয়ন্তীর উৎপত্তিস্থল। যে রাস্তা ধরে গিয়েছিলাম ঠিক সেই পথ ধরেই ফিরে এসেছিলাম তারপর। তবে সেইদিনের ভর দুপুরবেলা ফিরে আসার পথে পেটে ছুঁচোর হাহাকার ছাড়া আমাদের এত পরিশ্রমের ক্লেশ যেন আমাদের কান অবধি এসে পৌঁছায়নি।
– অন্বেষা দে
ছবি : গুগল