আজ উচ্চ মাধ্যমিকের নম্বরের কূটকচালি নিয়ে শিক্ষা মহলের কর্মকর্তা, প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ হইচই পড়ে গেছে। বিভাগ নির্বিশেষে বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী আশানুরূপ ফল এর থেকে এবছর অনেকটাই ভালো ফল করেছে। তার অন্যতম কারণ হল দুটি বা তিনটি বিষয়ের পরীক্ষা সম্পূর্ণ বাতিল হওয়া। মাধ্যমিকে 412 পাওয়া মেয়েটিও যখন উচ্চমাধ্যমিকে বায়োলজিতে 85 পাওয়ার নিরিখে ফিজিক্স কেমিস্ট্রিতেও গড় পঁচাশি করে পায়।
তখন তার প্রাপ্ত নম্বর গিয়ে দাঁড়ায় 405। আবার অন্যদিকে তথাকথিত মেধাবী মাধ্যমিকে 657 পাওয়া ছাত্রের বায়োলজিতে 90 এর ভিত্তিতে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি মিলিয়ে মোট নম্বর দাঁড়ায় 410। বলাবাহুল্য এ ধরনের মূল্যায়ন যদি ভবিষ্যতেও হয় আগামীদিনে শিক্ষার মেরুদন্ড আর সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মত অবস্থায় থাকবে কি?এখন প্রশ্ন হলো এই দুই ক্ষেত্রে ছাত্র এবং ছাত্রীটির মাধ্যমিকের নম্বর এর ফারাক 245 হলেও, উচ্চমাধ্যমিকে ফারাক মাত্র 5 এবং কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে মেধা তালিকার ভিত্তিতে দুজনেরই স্থান পাশাপাশি। এটা কি প্রকৃতপক্ষে সঠিক মূল্যায়ন হল?
সত্যি কি দুজনের মেধা এবং বুদ্ধি সম লেভেলে বিচার্য হাওয়া সাজে? শিক্ষা ব্যবস্থার চরম অরাজকতায়, আজ উচ্চমাধ্যমিকে যোগ্যতার থেকে বেশি নম্বর পাওয়া এইসব ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের মনে যে খুশির ঢেউ উঠেছে তা কি সত্যিই তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের পক্ষে খুশির বার্তা বহন করে আনবে?তাদের চাকরি তাদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই নম্বরের কূটকচালি কি পরবর্তীকালে কোন প্রভাব বিস্তার করবে না?
এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা যেতে পারে যে, শুধুমাত্র একটি সংখ্যা কোন ছাত্র বা ছাত্রীর গুণগত মানের সঠিক মাপকাঠি হতে পারে না। একথা সত্য এবং বহুজনের সমর্থনযোগ্য। কিন্তু তবুও একজন শিক্ষার্থীর পরিশ্রম এবং দক্ষতা সর্বোপরি মেধার কিছু শতাংশও প্রকাশিত হয় নম্বরের মাধ্যমেই।পরীক্ষিত শিক্ষাব্যবস্থার এই পদ্ধতিটি আদর্শভাবে প্রথম 1858 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে হেনরি সাহেবের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়।
তারপর থেকে প্রতিটি দেশের প্রতিটি নাগরিক বিশ্বাস ও সম্মানের সাথে পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা ও বুদ্ধির মূল্যায়নের এই প্রথা মেনে আসছে এবং ভবিষ্যতেও মেনে আসবে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এখন কিছু বিদ্ব্যদ্জন প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে,কোন কারনে (সে শারীরিক অসুস্থতাই হোক বা পারিবারিক অথবা মানসিক চাপ) একজন শিক্ষার্থী যদি মাধ্যমিকে কোন একটি বিষয়ে খারাপ ফল করে থাকেও, তবে তার মানে কি এই দাঁড়ায় যে সে উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করতে অসমর্থ হবে এবং মাধ্যমিকে নম্বর পাওয়া কৃতি ছাত্র-ছাত্রীর থেকে সে মেধা ও বুদ্ধিতে অনেক কমতি?
না, একেবারেই তা নয়। শতকরা 5 জন ছাত্র-ছাত্রীর ক্ষেত্রে মাধ্যমিকের নম্বর তার শারীরিক অসুস্থতা, পারিবারিক বা মানসিক অসুস্থতার উপর নির্ভর করে, যোগ্যতার থেকে কম আসতেই পারে। কিন্তু সেই সংখ্যাটা কখনোই 80% হতে পারে না। এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলের নিরিখে একথা অনায়াসেই বলা যায় যে, আনুমানিক 70 থেকে 75 শতাংশ ছাত্রছাত্রীর নম্বর তার টেস্টে প্রাপ্ত নম্বরের থেকে আশ্চর্যজনকভাবে অনেকাংশেই বেশি এসেছে।
এমন নজিরও ঘটেছে যে, টেস্ট পরীক্ষায় ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রি তে ফেল করা ছাত্র ছাত্রী ফাইনাল পরীক্ষায় 87-87 নম্বর পেয়ে অনায়াসেই 400 র কোঠা ছুঁয়ে ফেলেছে। এতে একদিকে যেমন ভেঙে পড়ছে প্রকৃত অর্থে মেধাবী-যোগ্য ছাত্রছাত্রীদের মনোবল, মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে তাদের রাত্রিদিন ব্যয় করা পরিশ্রম তেমনি অন্যদিকে সুগম করে তুলেছে কিছু স্বল্প পরিশ্রমী শিক্ষার্থীদের আরো বেশি করে ফাঁকি দিয়ে কার্যসিদ্ধির পথ। এই নম্বরের কূটকচালি কি সমাজের পরিশ্রমী এবং মেধাবীদের সাথে একরকম চরম জালিয়াতি নয়?
এবার প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে করা যাক। অনেকেই বলতে পারেন, করোনার মত মারণ ভাইরাসের দাপাদাপিতে সমগ্র বিশ্ব যখন থরহরিকম্প, তখন এই নম্বরের কূটকচালি নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা কি সত্যই যুক্তিযুক্ত? ফলপ্রকাশের এই ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন না করে, আর কোন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করলে মূল্যায়ন সঠিক হতো বলে মনে করা হয়?
তাদের উদ্দেশ্যে বলে রাখা ভালো, এক্ষেত্রে কিছু শিক্ষক শিক্ষিকা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের বক্তব্য হলো যদি টেস্ট পরীক্ষায় ফিজিক্স কেমিস্ট্রির নম্বরের ভিত্তিতে ফাইনাল পরীক্ষার নম্বর নির্ধারণ করা হতো তাহলে পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশে মেধার সঠিক মূল্যায়ন হত। কারণ বায়োলজির নম্বরের মাপকাঠি কখনোই ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রির মূল্যায়ন করতে পারেনা একমাত্র ফিজিক্স কেমিস্ট্রির নম্বর দিয়েই তা সম্ভব।
সুতরাং এই নম্বরের কূটকচালি আজকের দিনের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে শুধু ‘ট্রোল’ বা ‘মেমের’ খোরাকই নয় বরং ভবিষ্যৎ সমাজের কাছে যথেষ্ট আতঙ্কেরও। এই করোনা আবহাওয়া হয়তো একদিন কেটে যাবে, সমস্ত পৃথিবী আবার আগের মতোই স্বাভাবিক সচল হয়ে উঠবে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার এই চরম ভুল সিদ্ধান্তে ছাত্র-ছাত্রীদের ঝুলিতে যে নম্বরের কুটকচালি ঠেসে ঠেসে ভরে দেওয়া হলো তাতে ভবিষ্যতে করোনার থেকেও ভয়ঙ্কর আতঙ্কে পৃথিবীর মেরুদন্ড যে আবারো কেঁপে উঠবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।