ভূত না মানুষ (প্রথম পর্ব)

ভূত না মানুষ আজ দেখেই ছাড়ব মনে মনে ভাবল সৌজন্যা। প্রতি রাতের মতোই আজও বাড়ির পাশের কুকুর গুলো তারস্বরে ডাকছে সঙ্গে সেই ধূপধাপ শব্দ। না, আর বসে থাকব না ব্যপারটা এখনই দেখতে হবে, এই কথা ভেবেই সৌজন্যা বিছানা থেকে উঠে গেল। দীপ্তকে জাগানো চলবে না; সৌজন্যা বাদে বাড়ির বাকী কেউই নাকী কুকুরের ডাক ছাড়া অন্য কোনো শব্দই শুনতে পায়নি কোনোদিন কিন্তু সৌজন্যা এই রহস্য উদ্ঘাটন করে ছাড়বে এটাই তার পণ। কুকুরের ডাকটা আজ আরো বাড়ছে মনে হচ্ছে, যাই বলে ও ফোনটাতে সময়টা দেখে নিল রাত ২.৩০ এবার ফোনের ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে নিজের বেডরুম থেকে ও বাইরে এল। ওদের ডাইনিং – এর বড় জানলার সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তা ও বাড়ির সামান্য বাঁদিকে থাকা ফুলের বাগানটা দেখল। কই কিছুইতো নেই, কুকুরের ডাক থেমে গেছে। তাহলে কি এর মনের ভুল? হঠাৎ ওর মনে হল বাড়ির ছাদে কে যেন দৌড়াচ্ছে বা হাঁটাহাঁটি করছে, তাহলে কি চোর এল চুরি করতে? নাকি সত্যি  ভূূূত বলে কিছু আছে? একবার ছদে গিয়ে কি দেখব? কিন্তু এত রাতে একা একা ছাদে যাওয়া কি ঠিক হবে, দীপ্তকে কিছু বলাও যাবে না শুনলেন ও বলবে এটা ওর ছেলেমানুষী। ধূর ! সৌজন্যা কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। চারিদিকে অন্ধকার বাড়ির সবার ভয়ে লাইট জ্বালায়নি ও। দুম করে এক শব্দে সৌজন্যা চমকে উঠল, ছাদে কি হচ্ছে তা এবার ও দেখেই ছাড়বে। ভয়ে ভয়ে পা টিপে টিপে তিনটে সিড়ি পেরানোর পরই আআআআআআ শব্দ করে সৌজন্যা মাটিতে পড়ে গেল।

চিত্র : সংগৃহীত

যখন চোখ খুলল সৌজন্যা দেখল দীপ্ত, মামনি, বাবাই সবাই ওর পাশেই বসে আছে আর ওর মাথায় অসম্ভব ব্যথা। সৌজন্যার জ্ঞান ফিরতেই মিতা দেবী মানে সৌজন্যার শ্বাশুড়ি প্রশ্ন করলেন তুই কাল রাতে একা ছাদে গিয়েছিলি কেনো আর পরে গেলি কি করে? বাবু একটা আওয়াজ পেয়ে বাইরে গিয়ে দেখে তুই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছিস আর তোর মাথা ফেটে রক্তে ভেসে যাচ্ছ। এইমাত্র ডাক্তার চলে গেল। আর এমন ছেলেমানুষী করিস না কোনোদিন এখন একটু শুয়ে থাক আমি একটু নুন চিনির জল নিয়ে আসি তোর জন্য বলে মিতা দেবী ঘর থেকে চলে গেলেন। বাবাইও চলে গেল। সৌজন্যা ওর শ্বাশুড়িকে মামনি আর শ্বশুরকে বাবাই বলে ডাকে। ওইদিকে মামনি আর বাবাই চলে গেলেও দীপ্ত মুখভার করে সৌজন্যার পাশেই বসে রইল। কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ থাকার পর দীপ্ত বলে উঠল ভূত না মানুষ এই নিয়ে তো কম হয়রানি হল না। দিন নেই রাত নেই শুধু এক চিন্তা তোমার, বলি শান্তিতে আর খাওয়া ঘুম এ বাড়িতে হবে না নাকি! তোমার এই ছেলেমানুষী আর কতদিন চলবে মাম? নিজের কি বিপদ ঘটালে দেখলে তো। কিছুটা রেগে গিয়েই দীপ্ত সৌজন্যাকে কথাগুলো শুনিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। সৌজন্যা বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে এসেছে মাত্র দেড় বছর। তবে এরই মধ্যে সে হয়ে উঠেছে শ্বশুর শ্বাশুড়ির প্রিয় পাত্রী। দীপ্তও ওকে খুব ভালোবাসে ওকে বোঝে কিন্তু কেন যে ওর এই আওয়াজ শোনার ব্যপারটা বুঝতে চাইছে না। সৌজন্যা শুয়ে শুয়ে ভাবল এইসব নিয়ে আর ভাবব না, যবে থেকে বাড়িতে এই ভূত না মানুষের রহস্য এসেছে তবে থেকেই সৌজন্যার সাথে দীপ্তর সম্পর্কটা কেমন পাল্টে যেতে শুরু করেছে।

হঠাৎ মামনির ডাকে সৌজন্যার হুঁশ ফেরে মাম জলটা খেয়ে নে। মাম সৌজন্যার ডাকনাম, মিতা দেবী ওকে বিয়ের পর এই নামটা দিয়েছে। দেখতে দেখতে ১১ টা বাজল দীপ্ত ওকে সাবধানে থাকতে বলে অফিস চলে গেল। দুপুরের খাওয়া শেষ করে সৌজন্যা শুয়ে শুয়ে আগেরদিন রাতের কথা ভাবছিল। ওর বারবার মনে হচ্ছিল ওকে সিড়ি থেকে কেউ ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল কিন্তু সেটা কে? কোনো মানুষ তো তখনও ছাদ থেকে ঘরে আসেনি তাহলে কি সত্যিই এটা অশরীরীর কান্ড? না না কিসব ভাবছে ও আবার। একটু ঘুমাবে ভাবতেই ওর মনে হল আজ মঙ্গলবার ওর নাচের ক্লাস নেই কিন্তু কালতো ক্লাস আছে তবে এই অবস্থায় ও ক্লাস করাতে পারবে না। তাই ও আগামীকাল থেকে ক্লাস এক সপ্তাহ বন্ধ রাখবে সেটা সব ছাত্রীদের বাড়িতে সন্ধ্যেবেলা ফোন করে জানিয়ে দেবে। আসলে সৌজন্যার এ বাড়িতেই একটা নাচের স্কুল আছে; সোমবার, বুধবার ও শুক্রবার ও বিকেল ৪ টে থেকে সন্ধ্যে ৭ টা পর্যন্ত নাচ শেখায়। যেদিন ওর ক্লাস থাকে না সেদিন ও গান শুনে, নাচ প্র্যাকটিস করে, ল্যাপটপে সিনেমা দেখে কিংবা মিতা দেবীর সঙ্গে গল্প করে কাটায়। কিন্তু শেষ দুমাসে সৌজন্যার সাথে এমন কিছু অবাস্তবিক ঘটনা ঘটছে যা ওর মনকে ধীরে ধীরে সদিগ্ধ করে তুলছে। সৌজন্যা এইসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ল কিন্তু ১০ মিনিট যেতে না যেতেই হুড়মুড় করে ছাদে কি পড়ার শব্দে ওর ঘুম ভেঙে গেল। ছাদে যাবে ভেবে উঠতে গিয়েও ও শুয়ে পড়ল, ওর মাথায় খুব ব্যথা তাছাড়া আবার যদি ওর মনের ভুল হয় বা আবার ওর জন্য যদি বাড়িতে অশান্তি হয়, এমনিতেই দীপ্ত রেগে আছে। সৌজন্যার মনে হল আচ্ছা সবটাই কি ওর ভুল! সেই সেদিন এক বৃষ্টিস্নাত বিকালে ও আর ওর শ্বাশুড়ি জানলার ধারে বসে গল্প করছে হঠাৎ ও বলে উঠল মামনি দেখ এই বৃষ্টিতে মৌ ছাদে উঠে ভিজছে! বাড়িতে দাদা বৌদি নেই নাকি, ওদের বাড়িতে সবসময়ের জন্য যে বউটা থাকে ওই বা কোথায়? এইভাবে বৃষ্টিতে ভিজলে তো জ্বর হবে। মিতা দেবী বললেন তুই কি পাগল হলি মাম, নাকি ভূত দেখলি? ওদের ছাদ তো ফাঁকা, সৌজন্যা না বলে ওদের ছাদে তাকিয়ে দেখল সত্যি ছাদ ফাঁকা। ও মনে মনে ভাবল নিশ্চয়ই বকা খেয়ে মৌ নিচে নেমে গেছে।

হঠাৎ দরজায় ধাক্কা পড়ল সৌজন্যার চিন্তায় ছেদ পড়ল এবং ও প্রায় চমকে উঠে প্রশ্ন করল কে? আমি মামনি দরজা খোল তো ছাদে কিসের আওয়াজ হচ্ছে চল তো দেখে আসি। সৌজন্যা আস্তে আস্তে উঠে দরজা খুলে বলল মাথায় খুব ব্যথা মামনি যেতে ইচ্ছা করছে না গো কিন্তু ও যে একই আওয়াজ শুনতে পেয়েছে সেই সম্বন্ধে কিছুই বলল না মিতা দেবীকে। মিতা দেবী বলল চল আমি তোকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছি, ইচ্ছা না থাকলেও সৌজন্যা বলল ঠিক আছে চল।

চিত্র : সংগৃহীত

ছাদের সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে উঠতে উঠতে সৌজন্যার পা ভারী হয়ে গেল ওর চোখ প্রায় বেরিয়ে আসার উপক্রম। সেকি ভূত দেখছে?থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সৌজন্যা একি মামনি মাটিতে শুয়ে আছে আর মুখ থেকে গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরাচ্ছে কিন্তু মামনি তো আমাকে ধরে ছিল, আমার সাথে ছাদে উঠছিল তাহলে এখানে আগে থেকে মামনি পড়ে আছে কিভাবে? মাম চল ছাদে যাবি তো, কিরে কই গেলি? এটা তো মামনির গলা তাহলে সামনে কে শুয়ে কি হচ্ছে; এইসব কি হচ্ছে? সবটা গুলিয়ে যাচ্ছে সবটা এলোমেলো, সবটা অন্ধকার…

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *