কেন মেঘ আসে…(পর্ব-৫)

কারণে অকারণে কোলবালিশ অনেক ভিজেছে, কিন্তু মাথার বালিশ এই প্রথমবার। ‘ট্রুথ ইজ বিটার’ জানতাম, কিন্তু এত্তো তেঁতো স্বপ্নেও ভাবিনি। রাতেও মেটে চচ্চড়ি ছিল, তবুও খিদে নেই বলে নিজের ঘর আটকে বসে আছি বেশ কিছুক্ষণ। একটু আগে অবধিও কান্নাকাটি থামছিলো না, তারপর মাথায় এল ছোটবেলাতেই মা-বাবা শিখিয়েছে, ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। কেন কাঁদতে নেই জানি না, কিন্তু ওটা নাকি শুধু মেয়েদের দখলে। তাইতো ছোটবেলায় যতবার কেঁদেছি, ততবার কেউ না কেউ হেসে লুটোপুটি খেয়েছে এই বলে যে- “ছিঃ ছিঃ মেয়েদের মতো কাঁদে…”। আর আমিও খেয়াল করেছি এই কথাটা আমার মাত্রাতরিক্ত আত্মসম্মানে বাধে। তাই হাইস্কুলের দিনগুলো থেকেই ছোটখাটো ব্যাপারে খারাপ লাগলেও হাসি হাসি মুখ করে বসে থাকি।
কিন্তু মেঘ অনুর বয়ফ্রেন্ড, কথাটা যতবারই মাথায় আসছে ততবারই কেন যেন কান্না ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। একবার মনে হচ্ছে অনুকে ফোন করে শেষবারের মতো কথা বলে নিই, আবার ভাবছি সম্পর্কটা যখন সত্যিই শেষ! তখন আর এসবের দরকার নেই। অনুর জীবন থেকে নিঃশব্দে সরে আসাটাই বেটার।

মোবাইলটা খুলেই সোজা ফেসবুকটা ডিয়্যাক্টিভেট করলাম, অনুর ওই লাইফ ইভেন্টে কোনোরকম নাক গলালাম না। হোয়াটস অ্যাপ খুলে দেখলাম বেশ কয়েকটা ম্যাসেজ জমে আছে, তারমধ্যে অনুই পাঠিয়েছে খান ছয়েক। একবার ভাবলাম খুলে দেখি কি লিখেছে। তারপর ভাবলাম যখন কথা বলবো না ভেবেই নিয়েছি তখন অনুর সাথে আর কোনোরকম ভাবেই কথা বলবো না। সোজা সেটিংসে গিয়ে ডিলিট করে দিলাম অ্যাকাউন্ট, রিজেক্টলিস্ট করলাম অনুর নাম্বার।
মোবাইলটাকে প্রথমবার নিজের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে হচ্ছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল গায়ের যত শক্তি আছে, সবটা দিয়ে আছাড় মারি। কিন্তু ভেবে দেখলাম সত্যিই যদি ছুড়ে ফেলি আর তার ফলে যদি মোবাইলটা ভেঙে যায়, তবে আগামি কয়েকমাস আমাকে বাড়িতে পড়ে থাকা নোকিয়া এগারোশোটা দিয়ে কাজ চালাতে হবে। হোয়াটস অ্যাপ-ফেসবুকের প্রতি আগ্রহ যদিও আর নেই, কিন্তু এক্স-ভিডিওস ছাড়া থাকবো কীভাবে? তাই নিজের ভেতর তৈরী হওয়া জন সিনহাকে দমিয়ে রাখতে বাধ্য হলাম।

জন সিনহা দমলো তো আবার দেবদাস জেগে উঠলো। আবার মনে পড়ে গেল সম্পর্কের প্রথমদিনগুলো। সত্যি বলতে সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে ছটা মাস খুব কম সময় হলেও, এর মধ্যেই অনু আমার সবচেয়ে কাছের হয়ে উঠেছিল। ঘুম থেকে উঠে অনু, ঘুমোতে যেতে অনু। চলতে অনু, খেতে অনু, পড়তে বসতে অনু। শুধু একমাত্র সি.ও.সিতে ওয়ার অ্যাটাক দেওয়ার সময়টা বাদ দিয়ে ওকে নিয়েই ভাবতাম সারাদিন। হ্যাঁ ঝগড়ার দিনগুলোতেও ওই ছিল সবচেয়ে কাছের।
এসব ভুলে ঘুমোতে চাইছিলাম কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই কেন জানি প্রথমে অনুর সাথে চুমু খাওয়ার স্মৃতিগুলো মাথায় আসছিল, তারপর মেঘ এসে হাজির হচ্ছিল ভাবনায়। আবার কান্না পাচ্ছিল।

 

অনু, মেঘ, দেবদাস, জন সিনহা, সি.ও.সি; এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। ঘুম ভাঙলো ফোনের শব্দে। এত রাতে কে? অনু? অনুর নাম্বার তো ব্ল্যাকলিস্ট করা। তবে?
দেখলাম একটা অচেনা নাম্বার-

– হ্যালো
– ঘুমিয়ে পড়েছিলিস? ফোন কাটবি না প্লিজ।
– অনু? এটা কার নাম্বার?
– ঘুমিয়ে পড়েছিলিস?
– রাত তিনটে বাজে… এত রাত অবধি কেউ জেগে থাকে?
– আমি জেগে আছি।
– ওহ, মেঘের সাথে কথা বলছিলিস নিশ্চয়ই।
– আমার কিছু বলার আছে তোকে।
– আমার কিছু শোনার নেই। ভালো থাকি…
– দাঁড়া ফোন কাটবি না, একবার শোন
– বল…
– কাল দেখা করতে পারবি একবার?
– কেন?
– তোর দেওয়া জিনিসগুলো ফেরত দেবো, আর আমারগুলোও চাই।
– বাহ! মেঘ বলেছে নিশ্চয়ই? আগে তো কখনও কিছু আমার-তোর বলে দাবি করতিস না।
– ফেরত নেওয়ার থেকেও বড় কথা ফেরত দিতে চাই। অতীত আগলে পড়ে থাকার মেয়ে আমি নই।
– তাহলে জ্বালিয়ে দে, পুতে দে, ভাসিয়ে দে, আমাকে দেওয়ার কোনো দরকার নেই তো।
– আছে। ওটা করলে তোকে অপমান করা হবে, আর আমি সেটা চাইনা।
– খুব খেয়াল রাখিস তো আমার মান-অপমানের। দেখা করতে পারবো না, রাখলাম…
– ফোন কাটবি না প্লিজ, দেখ এটা আমার লাস্ট রিকোয়েস্ট।
– কোথায় দেখা করবি?
– আমাদের জায়গায়।
– আমাদের বলে কি আর কিছু বাকি আছে? ওই ঢাকুরিয়া লেক?
– সন্ধ্যে ছটায়।
– বেশ। বলছি সেদিন যে চকোলেটের বাক্সটা দিলি- শুধু বাক্সটা ফেরত দিলে হবে? নাকি নতুন কিনে দিতে হবে? চকলেটগুলো কিন্তু খেয়ে ফেলেছি সব।
-শুধু বাক্সটা দিলেই হবে। আর কিছু বলবি?
-নাহ, তুই?
– তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়িস, অনেক কান্নাকাটি করেছিস।
– আমি কেঁদেছি তোকে কে বললো? মানে আমি কোথায় কান্নাকাটি করেছি?
– কাল সন্ধ্যে ছটা, ঢাকুরিয়া লেক। গুডনাইট।

লেকে যখন পৌঁছালাম তখন সাড়ে ছটা বেজে গেছে। অনুর দেওয়া ওই চকোলেটের বাক্সটা খুঁজতে খুঁজতেই লেট হয়ে গেল। লেকে ঢুকতে ডানদিকে মাঠটা পার করে সোজা এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলাম অনুকে। কি সুন্দর লাগছে ওকে। একটু এগোতেই আবার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। দেখলাম অনুর পেছনেই মেঘ থমথমে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। অনুর তো একাই আসার কথা ছিল, তাহলে মেঘ কেন? আরেকটু এগোতেই বুঝলাম ওদের সাথে আরও কেউ একজন আছে…
কে? মেঘ কি তবে ওর কোনো বন্ধুকে নিয়ে এসেছে? তবে বোঝা যাচ্ছে ততীয় ব্যক্তিটি কোনো ছেলে নয়, মেয়ে। কে হতে পারে? আরও দু-চার পা এগোতেই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওটা আমার মাসতুতো বোন রাই না? হ্যাঁ তো রাই! আমায় দেখে মুখ লোকাচ্ছে। রাই ওদেরকে চিনল কিভাবে? মেঘ আর অনুর মাঝে রাই-ই বা কি করছে? – কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না।

অনুর সামনে যখন পৌঁছালাম তখন অনু আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে। আমি সোজা রাইয়ের দিকে প্রশ্ন তুললাম- “তুই এখানে কি করছিস? মাসি জানে?”
রাইয়ের মুখটা লাল হয়ে গেল। সাথে সাথে অনু বলে উঠলো, “বেশি দাদাগিরি দেখাতে হবে না। সব বলছি। চল বসি কোথাও।”
একটু অ্যাটিটিউড নিয়েই বললাম-
“আমি বসতে আসিনি, জিনিসগুলো দেওয়া নেওয়া কর, আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আর হ্যাঁ মাসিকেও একটা ফোন করতে হবে”।
রাইয়ের মুখটা দেখি আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মাথা নীচু করে মেঘের পেছনে এসে দাঁড়ালো। চোখ নামিয়েই বলল- টুপাইদা আমার তোকে কিছু বলার আছে।
– কি হয়েছে?
মেঘের পেছনে থেকেই শুধু মুখটা বের করলো রাই,
– আমি মেঘকে খুব ভালোবাসি।
বলেই আবার মুখ লুকিয়ে নিল।

“ক্কী?! মানে?! তুইও? মেঘকেই?” – মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে। এবার হয়তো পড়েই যাবো। চারিদিক কেমন যেন লাগছে, চেয়ে দেখলাম অনু এখনও হাসছে মিটমিটিয়ে, রাই মেঘে ঢাকা, আর মেঘের মুখ থমথমে…
অনুর দেওয়া গিফটগুলো নিয়ে বসে পড়লাম ওখানেই। তারপর…

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *