পঁচিশে বৈশাখ

“হৈমী উঠে পড় মা, অনেক বেলা হয়ে গেছে, আজও দেরী করবি তো!?” মা এর ধাক্কায় আট বছরের ছোট্ট হৈমী ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। এক মূহুর্ত সময় নেয় ঘোর কাটাতে। সত্যিই তো আজই তো পঁচিশে বৈশাখ, রবীন্দ্রজয়ন্তী! কোনোমতে মুখে চোখে জল দিয়েই দুরদারিয়ে নীচে নেমে আসে সে। মুখার্জিদের পৈতৃক বাড়ির বিশাল খোলা উঠোনটায় এই দিনটায় হইহই রব পড়ে যায়। অনেক বছর আগে হৈমীর ঠাকুমা সুধারাণী দেবী বাড়িতে রবি ঠাকুরের জন্মদিন পালন শুরু করেছিলেন। সেই প্রথা এখনো চলছে। একদিকে স্টেজ বাঁধা, আর একদিকে বাড়ির ছেলেমেয়েদের মধ্যে যারা একটু বড় তারা বসে পড়েছে টিফিনের প্যাকেট তৈরি করতে। দোতলার ঘরে জোর কদমে চলছে সান্ধ্য অনুষ্ঠানের ফাইনাল রিহার্সাল। হারমোনিয়াম, তবলা, ঘুঙুরের শব্দে বাড়ি ভরে উঠছে। ডেকোরেটরের লোক প্লাস্টিকের চেয়ার পৌছে দিয়ে গেছে, সেগুলো উঠোনের একপাশে ডাঁই করা। অনুষ্ঠানের মূল আয়োজন মুখার্জি বাড়িতে হলেও পাড়ার সব বাড়ির বাচ্চা বুড়োই সানন্দে এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়।

কচিকাঁচাদের নাচ গান থেকে শুরু করে পাড়ার সদ্য গোঁফ ওঠা বা সদ্য শাড়ি পরতে শেখা ছেলেমেয়েদের গীতিনাট্য-নৃত্যনাট্য, মা-কাকিমাদের কোরাস, এক মাস ধরে সবকিছুর প্রস্তুতি চলতে থাকে। বাবা কাকারা সামলান ডেকোরেটর বা বাইরের কাজকর্ম। দল বেঁধে বাচ্চারা দু একদিন যায় পাড়ার সব বাড়িতে চাঁদা তুলতে, ভালোবেসে সবাই দেয়ও সাধ্যমত আর বাকিটা আসে সুধারাণী দেবীর জিম্মা থেকে। ওনার বয়েস হচ্ছে, তাই ওনার মেয়ে তথা হৈমীর একমাত্র পিসি অনিতাই এখন এসব আয়োজনের দায়িত্ব নেয়। রোজ নিয়ম করে রিহার্সাল করানোর ভারও তার ওপরই। পান থেকে চুন খসলেই বকাঝকাও জোটে কপালে। অনিতা রবীন্দ্রভারতীতে গান নিয়ে পড়াশোনা করেছে তাই সাংস্কৃতিক বিষয়ে তার জ্ঞান ও আগ্রহ দুইই বেশি।

আজ আবার হৈমীর জন্মদিনও, আজকের দিনটার বিশেষত্বর জন্যই ছোট থেকে তার বাংলা জন্মদিন পালন হয়। এই দিনটায় তারও একটা আলাদা খাতির বাড়িতে। ঠাম্মা বলে বড় হয়ে হৈমীও রবি ঠাকুরের মতো অনেক নাম করবে। উঠোন থেকেই রান্না ঘরের গরম গরম লুচি ভাজার গন্ধ পায় সে, সাথে মা জেঠিমাদের অনুষ্ঠানের জল্পনা আর পিসিমণির দরাজ গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত।একদিকে ভিয়েন বসেছে সেখানে সন্ধ্যার জন্য মিষ্টি বানানো হচ্ছে, আর সকালে জলখাবারে লুচির সাথে বোঁদের আয়োজন। গন্ধ ছড়িয়েছে বেশ। পাড়ার বাচ্চাগুলোও আজ এই বাড়িতেই জলখাবার খাবে। একটু পরে যারা রিহার্সাল করছিল সবাই এসে পড়বে, এক এক করে বসে পড়বে কাঠের টানা বেঞ্চি গুলোতে, পাতে পরবে ধোঁয়া ওঠা লুচি আর বোঁদে।

এর মাঝে আকাশ কালো করে কালবৈশাখি। হৈমীদের উঠোনের কোণে মস্ত আমগাছটা, ঝড় হলেই ধুপধুপ আম পড়ে আর ওরা সবাই কম্পিটিশন করে আম কুড়োনোর। এর মাঝে সকালের পর্ব চটজলদি মিটিয়ে বিকেল থেকে শুরু হবে সাজপর্ব। পাড়াতুতো দিদি, কাকিমাদের কাছে বছরে এই একটামাত্র দিন সাজার সেকি আনন্দ!!! মায়ের লাল লিপস্টিকটায় হাত দিলেও আজ বকুনি জুটবেনা। শাড়ি, ধুতি, জুঁই ফুলের গন্ধে পরিবেশ তখন স্বর্গীয়।তারপর সন্ধ্যে নামলে খালি চেয়ার গুলো সব ভরে উঠবে। সবাই জড়ো হবে মুখার্জিদের উঠোনে। নাচ, গান, নাটকে মুখরিত হবে চারিদিক। কেউ নাচের মাঝে কুঁচিতে পা জড়িয়ে হোঁচট খাবে, নাটকের মাঝেই ধুতির কোঁচা খুলবে কারো, কেউ ভুলে যাবে স্ক্রিপ্ট, হাসির রোল তুলবে দর্শকরা, আর ব্যাকস্টেজে পিসিমণি রাগে দাঁত কিড়মিড় করবে…

“হৈমী উঠ যাও, দেখো কিতনা লেট হো গয়া। হ্যাপি বার্থডে সুইটহার্ট…” হঠাৎ করে এক ধাক্কায় এমন সুন্দর স্বপ্নটা ভেঙে হকচকিয়ে বিছানায় উঠে বসে হৈমী। কুড়ি বছর পেছনে ফেলে আসা শৈশব থেকে বাস্তবে ফিরতে সময় লাগে একটু। হৈমন্তীকা মুখার্জি এখন ব্যাঙ্গালোরে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরতা। নীল, ওর স্বামী নীলেশ জয়সওয়াল সামনে একটা চকোলেট কেক আর ক্যান্ডেলস নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। হৈমীর মনে পড়ল আজও পঁচিশে বৈশাখ, অদ্ভুতভাবে এবার বাংলা আর ইংরেজি জন্মদিন একদিনে পড়েছে। নয়তো অবাঙালি নীলের বাংলা মাসের হিসেব থাকার কথা নয়। নীলকে অনেকবার বলেছে ওর ছোটবেলার কথা, বাড়ির রবীন্দ্রজয়ন্তীর কথা। নীল হয়তো বোঝে এই দিনটা সে কিছু একটা মিস করে, কারণে অকারণে অন্যমনস্ক হয়ে যায়… কি মিস করে হৈমী? ছোটবেলা?! সুধারাণীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রজয়ন্তীর জৌলুস কমতে শুরু করে। তারপর পিসিমণিরও বিয়ে হয়ে যায়। পড়াশুনো, চাকরির জন্য পাড়ার ছেলে মেয়েরাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। আম গাছটাও আর নেই। শুধু মুখার্জি বাড়ির বিশাল উঠোনটাই এক নস্টালজিয়ার সাক্ষ্য হয়ে পেছনে রয়ে গেছে।

কেকটা কেটে নীলকে খাওয়ালো ও। নীল ওর কপালে একটা স্নেহচুম্বন এঁকে আর একবার উইশ করতে না করতেই ফোনটা বেজে উঠল তার, সেটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল নীল। ব্যাঙ্গালোরে চাকরি নিয়ে আসার পর এখানকার বেঙ্গলি এসোসিয়েশন এর কিছু ইভেন্টে গেছে হৈমী। প্রবাসী বাঙালীরা মিলে দুর্গাপুজো হোক বা রবীন্দ্রজয়ন্তী হুজুগে কমতি নেই কিন্তু এই ডিজিটাল, চাকচিক্যপুর্ণ জগতে ছোটবেলার আটপৌরে অনুষ্ঠানের প্রাণ পায়না সে। যদিও আজকালকার বাচ্চাগুলোর আধুনিক আদবকায়দায় ‘সেলিব্রেশনস’ দেখতে মন্দ লাগেনা, অন্তত এটুকু বাঙালি সংস্কৃতি শিখছে ওরা। আজ রাতে ওখানকার অনুষ্ঠান দেখে নীলের সাথে রেস্তরাঁয় ডিনার করে ফিরবে। হঠাৎই খেয়াল পড়ল অনেকগুলো ফোন আসছে আজ নীলের। কার কে জানে! হয়তো অফিস থেকে। দুজনেরই তো আজ ছুটি। বাড়ি থেকে এখনো কেউ ফোন করেনি। আশ্চর্য ব্যাপার, এরকম আগে কোনোদিন হয়নি।নিজের উদ্যোগেই ফোন করে দেখে মায়ের ফোন সুইচ অফ আর বাবার ফোন বলছে ব্যস্ত… ভাবতে ভাবতেই ডোরবেল বাজলো।নীল এখনো ফোনে, বারান্দা থেকে মাঝেমাঝেই ইঙ্গিতপুর্ণ দৃষ্টিতে দেখছে ওকে। অগত্যা দরজাটা হৈমীই খুললো।

“সারপ্রাইজ!”, নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছেনা। মা, বাবা, কাকু, কাকিমা, জেঠুমণি, জেম্মা,পিসিমণি, পিসেমশাই, জেঠতুতো-খুড়তুতো দাদাদিদি মিলিয়ে জনা পনেরো মানুষের গলার আওয়াজে ওদের 2 BHK ফ্ল্যাটটা গমগম করছে। এসেই বাবা-কাকুমণি ছুটেছে পাশের সুপার মার্কেটে। পিসেমশাই আর জেঠুমণির চায়ের কাপে রাজনীতি জমে উঠেছে। নীল মাঝে মাঝে যোগ দিচ্ছে তাতে। মা-কাকিমাদের হাতের ছোঁয়ায় মডিউলার কিচেনটা প্রাণ পেয়েছে আজ। সোনাদা গিটারে সুর তুলেছে, রিনিদি হাসতে হাসতে বলছে কিভাবে নীল সব প্ল্যান করেছে…

সন্ধ্যেবেলা এক টুকরো পশ্চিম বাংলা উঠে এলো যেন ব্যাঙ্গালোরের ফ্ল্যাটে। শাড়ি আর ফুলের মালায় চিরন্তন বাঙালী সাজে রোজকার জিন্স টপ পরিহিতা স্ত্রী কে যেন চিনতেই পারছেনা নীল। তাকেও জোর করে ধুতি পরিয়েছে কাকুমণিরা। বাঙালী আদবকায়দায় অনুষ্ঠানে নীল অভ্যস্ত নয়, সব কিছু ক্যামেরাবন্দি করছে সে। বহু বছর পর এমন রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলো হৈমী। সবাই করলো কিছু না কিছু। আজ রবীন্দ্রজয়ন্তী। রাতের মেনুতেও সব বাঙালি খাবার।অনেক বছর পর জন্মদিনে মায়ের হাতের পায়েস খেলো সে। ঠাম্মার কথা মনে পড়ছে, আজ নিশ্চয়ই ঠাম্মাও ওদের দেখে খুব খুশি হচ্ছে। একটা অবাঙালী ছেলে তাকে হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলা ফিরিয়ে দিয়ে জন্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহারটা দিল।

ছোটবেলায় বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে যেমন সবাই তোষক বিছিয়ে ঢালাও বিছানায় শুতো, আজও সেই ব্যবস্থা। নীল হোটেলের বন্দোবস্ত করতে চেয়েছিল, কেউ রাজি হয়েনি। আজ শুধু হৈমী না বাকিরাও ফিরে গেছে ফেলে আসা দিনগুলোয়।
হোয়াটসঅ্যাপে নীলের বার্তা পেয়ে অনেক রাতে মায়ের পাশ থেকে হৈমী উঠে এলো বারান্দায়। সারাদিন তারা নিজেদের জন্য সময় পায়নি একটুও। নীল একটু ঘন হয়ে দাঁড়ালো, হৈমী মাথাটা রাখলো চওড়া কাঁধে। বৃষ্টি হচ্ছে খুব, ঠাম্মা বলতো পঁচিশে বৈশাখে বৃষ্টি হবেই। ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে ওদের।

– “খুশ হো!?” নীল আলতো স্বরে নিরবতা ভাঙলো। উত্তর না দিয়ে হৈমী ওর হাতটা ধরলো শক্ত করে। কিছু অনুভূতি শব্দে প্রকাশ করা যায়না, সেগুলো বুঝে নিতে হয় মাত্র…।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *