একটি রাতের কল

কল করতে গিয়েও ফোনটা কেটে দিলো চিনি। কান্নাটা গলার কাছে আটকে আছে যেন। অর্ক এটা কি করে করতে পারলো ওর সাথে? এতদিনের ওর বিশ্বাস, ভালোবাসার এইভাবে দাম দিলো অর্ক? শপিং মলে রিতুর সাথে যখন অর্ককে দেখল নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলনা চিনি। বিদিশা, চিনির বেস্ট ফ্রেন্ড, অনেক আগেই চিনিকে রিতুর সাথে অর্কর মেলামেশার ব্যাপারটা জানিয়েছিল। চিনি হেসে উড়িয়ে দেয়। হাসবে নাই বা কেন? পাঁচ বছরের সম্পর্ক ওদের। সেই স্কুল লাইফ থেকে প্রেম কলেজ পর্যন্ত গড়িয়েছে। পাগলের মত অর্ককে ভালোবাসতো চিনি।

শুধু কি ভালোবাসাই? অর্কর বাড়ির অবস্থা ভালো নয়, বাবাকে হারিয়েছে ছোটবেলায়। মা দুই বাড়িতে রান্নার কাজ করে আর অর্ক টিউশন পড়ায়। এতেই ওদের সংসার চলে। অর্কর একটা বোন আছে। তার পড়ার খরচও অর্ক চালায়। কতদিন এমন হয়েছে চিনি লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু টাকা অর্কর মায়ের হাতে দিয়ে এসেছে। কাকিমা নিতে চায়নি, চিনি জোর করেই দিয়েছে। তাছাড়া অর্কর বোনকেও চিনি পড়া দেখিয়ে দিত। নিজের পুরোনো নোটসগুলোও দিয়ে দিত। কাকিমা তো চিনিকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতো। আর অর্ক? অর্ক তো চিনিকে চোখে হারাত! কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় যতক্ষণ না চিনি বাড়ি পৌঁছত, অর্কর সাথে ফোনে ওকে কথা বলতেই হতো। একবার চিনির খুব জ্বর হয়েছিল, পাঁচদিন কলেজ যেতে পারেনি। অর্ক রোজ কলেজ শেষ করে দেখতে আসতো। চিনির প্রজেক্টও লিখে দিত। সেই অর্ক…

বেশ কিছুদিন ধরেই অর্কর ব্যবহার একটু অদ্ভুতই লাগছিল চিনির। আগেরমত ফোন করত না। ক্লাসেও কেমন একটা এড়িয়েই যেত। প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো চিনির। পরে ভেবেছিল সামনে ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা, তাই হয়তো…। কিন্তু আজ রিতুর সাথে অর্ককে মলে ওভাবে দেখে..। অর্ককে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিল চিনি অর্ক কোথায়। “টিউশন পড়াচ্ছি, ডিস্টার্ব করিস না” বলে ফোন কেটে দেয় অর্ক।

মোবাইলটা আবার হাতে নিল চিনি। ” নাহ্, অর্ককে আজ বলতেই হবে কেন এমন করলো আমার সাথে”, ওপারে কল রিসিভ হতেই চিনি বলতে শুরু করল,” বেইমান, বিশ্বাসঘাতক, কি করে আমার সাথে এরকম করতে পারলি তুই! এতদিনের সম্পর্ক আমাদের, এই দাম দিলি তুই! কোনোদিন সুখী হবিনা ওই রিতুর সাথে! আমি তোকে…

– আরে ম্যাডাম আমাকে একটু বলতে দিন প্লিজ!

– হ্যালো, কে আপনি? গলাটা কেমন লাগলো! অর্ক রায়ের নাম্বার তো এটা?

– সরি ম্যাডাম, আমি অর্ক রায় নই, আমার নাম সৌম্য গুপ্ত। মনে হয় ক্রস কানেকশন হয়ে গেছে। আমি অনেকক্ষন ধরে এটাই বলার চেষ্টা করছিলাম আপনাকে।

ক্রস কানেকশন! নিজের জিভ কাটলো চিনি। কি সব বলে গেলো এতক্ষণ একজন অচেনা অজানা মানুষকে।

– সরি মানে ইয়ে মানে আসলে আমি ভেবেছিলাম…

– আপনার প্রেমিক যে আপনাকে ঠকিয়ে রিতু নামের কোনো একজনের সাথে সম্পর্কে রয়েছে তাই তো?

– আপনি কি করে জানলেন এসব?!

– ম্যাডাম, এতক্ষণ ধরে আপনিই তো সব হিস্ট্রি জানালেন!

– এবাবা! সরি প্লিজ কিছু মনে করবেন না, আসলে আমারই ভুল, ওই প্রান্তের কথা কোনো কথা না শুনে আগেই আমি…

– হয় হয়, প্রেমে গাড্ডা খেলে এমন হয়!

– আপনি কি আমার লেগপুল করছেন?

– নানা এমা ভুল বুঝছেন। আসলে আমিও আপনার মতই ভুক্তভোগী কিনা! জাস্ট দুই দিন আগে আমার রাধা আমাকে বিবাগী করে অন্য কৃষ্ণর কাছে চলে গেছে! তাই আপনার পরিস্থিতি খুব ভালই বুঝতে পারছি।

– আপনিও আমার মতোই! আশ্চর্য! তো আপনার রাগ হচ্ছেনা?

– রাগ করে কি হবে ম্যাডাম! যে যেখানে যার সাথে ভালো থাকতে চায় তাকে সেখানেই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। জোর করে বেঁধে রেখে আর যাই হোক, ভালোবাসা মেলে না। আচ্ছা আপনারা নাম? আসলে বারবার ম্যাডাম বলতে কেমন একটা লাগছে তাই। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।

ছেলেটা বেশ ভালো কথা বলতে পারে তো! কিন্তু নাম বলা কি ঠিক হবে? বলবে কি বলবে না ভেবে বলেই দিলো চিনি।

– আমার নাম চিরন্তনী, চিরন্তনী সেন।

– চিরন্তনী! বাহ্! আপনারা নামটা কিন্তু খুব সুন্দর। তা একটা কথা বলবো? দেখুন, আপনার সম্পর্ক কতদিনের, কেমন ছিল আমি জানিনা। কিন্তু যদি ছেলেটাকে সত্যি ভালোবাসেন তাহলে ওকে ওর মত ছেড়ে দিন। আজ আপনি যদি ওকে আটকে রাখতে চান, হয়তো সে থেকে যাবে। কিন্তু পরে যে কোনোদিন যাবেনা তার গ্যারান্টি কি? অনেক সময় ছাড়ার মধ্যেও ভালোবাসার জয় লুকিয়ে থাকে। আর কে বলতে পারে? ওই ছেলেটার থেকেও অনেক বেটার কেউ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে হয়তো। হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন? চিরন্তনী?

শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল চিনি। সৌম্যর ডাকে সম্বিত ফিরে এলো।

– না না, আমি শুনছি। আই মাস্ট সে, খুব সুন্দর কথা বলেন আপনি। বেশ লাগে শুনতে।

– তাই? তাহলে আরেকটু বলি? অতীতকে ফ্লাশ করে দিন। কাল থেকে নতুন করে শুরু করুন। আপনি আনন্দে থাকলে দেখবেন ওই ছেলেটিই আপনাকে দেখে হিংসে করবে। মন খুলে বাঁচুন চিরন্তনী ম্যাডাম।

অদ্ভুত ভালোলাগায় মনটা ভরে গেল চিনির। কই অর্ক তো কখনো এইভাবে এত সুন্দর করে ওর মন ভালো করতে পারতনা! তবে কি…

হঠাৎ মায়ের গলা পেলো চিনি।

– এই মা আসছে, আমি রাখছি। বাই।

ফোনটা কেটে দিয়ে হুঁশ ফিরল চিনির। “পরে চাইলে কথা বলবো কি করে! ফোনটা তো ক্রস কানেকশন ছিল! ধুর! কিচ্ছু ভালো হয়না আমার সাথে।” রাগে মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে টুং করে মেসেজ টিউন ভেসে এল।

স্ক্রীনে একটা মোবাইল নাম্বার, আর লেখা ‘আমি সৌম্য, এটা আমার নাম্বার, ক্রস কানেকশন নয়। এবার চাইলে সরাসরি আমার নাম্বার এ কথা বলা যেতে পারে..চিরন্তনী ম্যাডাম।’

মুখে হাসি ফুটলো চিনির।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *