চিরঞ্জিবী

যার মৃত্যু নেই তাকে বলা হয় চিরঞ্জিবী। সত্যিই এমন কিছু কী আছে, যার মরণ নেই! আছে, তিনি হলেন শিক্ষক। সবার জীবনেই বট বৃক্ষের মতো কোনো না কোনো শিক্ষকের অস্তিত্ব থাকে। গল্পটা পড়তে পড়তে রিনার এই কথাই মনে হচ্ছিল, শ্রদ্ধায় মাথা নত হচ্ছিল অজান্তেই। ‘গল্প হলেও সত্যি’— এই কথাটা খুব প্রচলিত, আসলে সত্যকে অবলম্বন করেই যে গল্প বেড়ে ওঠে। তাই এটা গল্প নয়, সত্যি।

সকাল হতে না হতেই স্কুলের বাইরে ভিড় জমে গেছে। সবাই একবার করে স্কুলের গেটে উঁকি দিচ্ছে। বিষয়টা অবাস্তব কিছু নয়, সারি সারি চারা গাছ জড়ো করা দেখেই সবাই চমকে উঠছে। বলা কওয়া হচ্ছে “এ কী করে সম্ভব! অধীর বাবু এলেই জানা যাবে।” কেউ কেউ কপালে হাত ঠেকিয়ে বলছে,“বড়ো স্যারের আশীর্বাদ গো…” বর্তমান প্রধান শিক্ষক অধীর বিশ্বাস এসে তিনিও হতবাক। এসব আয়োজন তিনি তো করেননি! তবে অন্য কেউ করলো? কেউ তো ওনার অনুমতি নেয়নি! অফিস ঘর খুলে দেখে লাট দেওয়া খাতা, পেন, পেন্সিল। দেখে কেমন যেন গা ছমছম করে উঠলো। এমন ভূত দেখার মতো করে চমকে ওঠার কারণ বড়ো স্যার আর নেই। ১৫ই আগস্ট তিনি ইহ জগতের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন। পাঁচ দিন আগেই তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।

সকাল হতে যাচ্ছে না এক বার স্কুল গেটে উঁকি দিচ্ছে। বিষয় অবাস্তব কিছু নয়, সারি সারি গাছগুলি দেখতে হবে এটা কি সম্ভব? অধীর বাবুর এ আদেশ হবে। কেউ কেউ কপালে হাত ঠেকিয়ে আলোচনা করে, “বড়ো জোরের আশির্বাদ গো…” বর্তমান প্রধান শিক্ষক অধীর বিশ্বাস তিনিও আসতেন। একমাত্র তিনি আপনি করেছেন! তবে অন্য কেউ করলো? কেউ যদি ওনার কথা বলতে পারে! অফিসের খোলা জায়গা লট দেওয়া হবে, পেন, পেন্সিল। কোন বিষয়ে জানা গা ছমছম করে উঠলো। এমন ভূত দেখার মতো করে চমকে ওঠার কারণ বড়ো বড়ো আর নেই। ১৫ই আগষ্ট তিনি ইহের প্রস্তুতি মায়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। পাঁচদিনের মধ্যে তিনি পার্লৌকিকভাবে কাজ শেষ করেছেন।

শ্রী ইন্দ্রদেব বর্মন মহাশয় দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর ধরে এই ভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। শেষ আঠারো বছর প্রধান শিক্ষক ছিলেন। নিজের হাতে স্কুলটিকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। সরকারি অনুদানের অপেক্ষায় না থেকে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রদের সাহায্যের হাত বাড়াতে বলেছেন, তারাও তাঁর এক কোথায় মুক্ত হস্তে বিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পে দান করেছে। সকলের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবার বড়ো স্যার। হেড মাস্টার হওয়ার বছর থেকেই তিনি নিজ উদ্যোগে শিক্ষক দিবসের দিন সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী ও গ্রামবাসীকে চারা গাছ উপহার দিতেন। এমনকি অবসর গ্রহণের পরও তিনি এই একটা দিন স্কুলে আসতেন। সকলকে ভালোবাসা, আশীর্বাদে ভরিয়ে দিতেন; আর ছড়িয়ে দিতেন সবুজায়নের মন্ত্র।

স্কুলের বিশ্বস্ত পুরোনো দারোয়ান রামপ্রসাদের ডাক পড়লো। রাতে স্কুলের চাবি তার কাছেই থাকে। জিজ্ঞাসাবাদ চলল অনেকক্ষন। তার বক্তব্য সে কিছুই জানে না। কান্নায় ভেঙে পড়েছে এক্কেবারে। গ্রামবাসীর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো— এ বড়ো স্যারের আশীর্বাদ। বড়ো স্যার বলতেন,“কখনো বিচার বিবেচনা না করে অন্ধভাবে বিশ্বাস করবি না। শিক্ষিত হতে গেলে আগে কুসংস্কার মুক্ত হতে হয়।” তাই কেউ কেউ মনে করে এর পিছনে নিশ্চই কোনো রহস্য আছে।

তার পর কেটে গেছে সাত বছর। প্রতি বছরই ৫ই সেপ্টেম্বর অলৌকিক ভাবে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এবছর বড়ো স্যারের স্মৃতির উদ্দেশ্যে খেলার মাঠের একদিকে ‘মিলন মঞ্চ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। মাঠটা জনসমাগমে ভরে গেছে। অধীর বাবু স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বড়ো স্যারের বলা একটা গল্প তুলে ধরলেন— গল্পটা একটা শিক্ষকের। মৃত্যুর পর শিক্ষক গোলোকধামে গেছেন। সেখানে তাঁকে যত্নসহকারে সিংহাসনে বসিয়ে অ্যাপায়ন করা হচ্ছে। পুণ্যের খাতায় অনেক কিছু লেখা, তার দরুণ কত উপহার পাচ্ছেন। যেদিকেই চোখ যায় শুধু সুন্দরের প্রতিচ্ছবি। তখন শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন,“আমি সত্যিই কি এতো পূণ্য করেছি ভগবান?” ভগবান হেসে উত্তর দিলেন,“তুমি একা করোনি, যাদের তুমি শিক্ষাদান করেছো, তারাও তোমার দেখানো পথে হেঁটে সৎ কর্ম করেছে। তোমার কর্ম ও তাদের শ্রদ্ধা ভক্তির জোরেই তুমি এতো সুখের অধিকারী হয়েছো আজ…” এটা কেবল গল্প মাত্র, কিন্তু আসলটা হল সত্যিই শিক্ষকের মৃত্যু নেই, তিনি বেঁচে থাকেন শিক্ষার্থীর আচরণে, সুশিক্ষায়। কিছু মানুষ এভাবে তাঁর কর্মের মধ্যেই বেঁচে থাকেন। গল্প শুনতে শুনতে চোখে জল এলো সবার। একদম শেষে বসে থাকা আঠাশ-ঊনত্রিশ বছরের দুটি ছেলের মুখে প্রসন্নতার হাসি। দুজনে চোখ চাহাচাহি করে একসঙ্গে বলল,“আমাদের বড়ো স্যার গোলোকধামে গেছেন। আজ গোলোকধামে শিক্ষক দিবস।” ওদের কাঁধে হাত রেখে হাসল দারোয়ান রামপ্রসাদ।বড়ো স্যার সত্যিই কয়েকটা মানুষ গড়তে পেরেছিলেন। তাই সত্যের আড়ালে রহস্য আজও রহস্যই রয়ে গেল!

–অর্যমা

এটাও পড়ে দেখতে পারেন – ওরা যারা নীল প্রতিফলনে প্রেমিক-প্রেমিকা

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *