দুই পৃথিবী

দৃশ‍্যপট: এক

শপিং মল থেকে বেরিয়ে সবে রোদ চশমা টা চোখে গলিয়েছে শ্রী; হঠাৎ পেছনে কুর্তিতে এক টান। ঘুরে দেখে কালো মতো লিকপিকে একটি ছেলে। বয়স সত‍্যিই বারো কি তেরো, গায়ে শতছিন্ন একটা জামা আর হাতে একটা তবড়ানো বাটি-

“দিদি পাঁচ টা টাকা দাও না গো, খুব ক্ষিদে পেয়েছে।” ছেলেটার চোখে করুণ আকুতি।
– “এই ছাড় ছাড়। সরে যা হতভাগা, যত্তোসব হাড় হা-ভাতের দল।”

ছেলেটাকে প্রায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে নিজের মনেই গজ গজ করে গাড়ির দিকে হাঁটা লাগালো সে। একেই আজ মুড টা ঠিক নেই একদম, পরের হপ্তায় ওর আঠারোতম জন্মদিন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার প্রাক্কালে বাপির কাছে এবার আদরের মুনিয়ার বায়না ছিল একটা হাল ফ‍্যাশনের ডিজাইনার গাউন। সেই মতো এই শপিং মলে গাউন নিয়ে একটা ছোটখাটো গবেষনাও করে ফেলেছিল সে। কিন্তু আজ শেষমেশ বাপির ক্রেডিট কার্ড হাতে পেয়ে মলে এসে দেখে পছন্দের গাউন অলরেডি সোল্ড। কত্তো পরিকল্পনা ছিল জন্মদিনটায় মহুয়া, অর্পিতা, মালবিকাদের একদম তাক লাগিয়ে দেওয়ার। নাহ্, সে আর হল না; ভেবেই চোখের কোন টা চিকচিক করে উঠলো। গাড়ির মধ‍্যে ঢুকেই এয়ার-কন্ডিশন এর তাপমাত্রা কিছু কমিয়ে দিল ও। কে জানে যদি মাথা টা একটু ঠান্ডা হয়।
পেছনে পড়ে রইল প্রথম গ্রীষ্মের দুপুরের খরতাপের মাঝে তিন দিনের উপোসি পেট আর চোখের জল। শুধুমাত্র কয়েকটা টাকার জন‍্য একটা ক্রেডিট কার্ড বা মানুষের পুরো মনটাও হয়তো কম পড়ে যায় কখনো।

দৃশ‍্যপট: দুই

অসংখ‍্য ফ্ল‍্যাশের ঝলকানি আর হাততালির মাঝে মঞ্চ থেকে নেমে এলেন মাননীয়া রমলা রয়। রমলা দেবী ‘নারী কল‍্যাণ ও নারী উন্নয়ন সমিতি’র সভাপতি। সবাই এক বাক‍্যে স্বীকার করে যে মহিলাদের স্বনির্ভর হওয়ার পেছনে ওনার অবদানের পাশাপাশি উনি একজন অসাধারন বক্তাও। আর আজকে নারী স্বাধীনতা নিয়ে ওনার ভাষন তো সবাইকে মোহিত করে দিয়েছে। মঞ্চ থেকে নামা ইস্তক প্রশংসায় ভরে আছেন উনি। এসব স্তুতিবাক‍্য যদিও আজকাল গা সওয়া হয়ে গেছে, তবুও শুনতে নেহাতই মন্দ লাগেনা রমলা দেবীর। বেশ একটা আত্মতুষ্টি আসে। ফুরফুরে মেজাজেই বাড়িতে ফিরে ড্রয়িং রুমের মস্ত সোফায় গা এলিয়ে দিলেন। সবসময়ের পরিচারিকা চা দিতে এলে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “হ‍্যাঁ রে, মল্লিকা কোথায়?”

– “বৌদিমনি তো নাচের ইস্কুলে গেছে মা।”
ফুরফুরে মেজাজ হঠাৎ রুক্ষ হয়ে উঠলো। বাড়ির নব বিবাহিত বৌ এর এসব ধিঙ্গিপনা তো সহ‍্য করা যায়না। নাহ্ আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে।
সন্ধ‍্যেবেলা ডেকে বললেন, “শোন বৌমা কাল থেকে তোমার ওসব নাচের স্কুল-ফুল সব বন্ধ বুঝেছ? অনেক হয়েছে এবার এই বেহায়াপনা ছাড়ো।”
– “কিন্তু কেন মা ? আমি তো সেই ছোট্ট থেকেই নাচ শিখেছি; ওটা যে আমার খুব প্রিয়।”
– “সে বিয়ের আগে যা করেছ করেছ, এখন আর তা চলবে না। আমি তোমার বাবা মাকে বলেই ছিলাম আমরা একমাত্র ছেলের জন‍্য আমি একজন হাউজওয়াইফ চাই, কোনো নাচিয়ে মেয়ে নয়!”
– “কিন্তু মা…”
– “আর কোন কিন্তু নয়, এই আমার শেষ কথা। আর ওসব নাচ গান করলে বাপু এ বাড়ির পাট তোমাকে চোকাতে হবে। ”
রমলা দেবী বেশ ভালোই জানেন এ বাড়ির পাট চুকিয়ে তার আরো দুই কন‍্যাদায়গ্রস্ত বাবার কাছে ফিরে যাওয়ার সাহস তার পুত্রবধূর হবেনা। আর ওসব নারী স্বাধীনতা, নারী স্বাবলম্বী ভাষনেই ভালো লাগে, নিজের বাড়ির চার দেওয়ালের মধ‍্যে নয়।

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *