লিফলেট

আজ দিনটাই খারাপ। সকাল থেকেই কিছু না কিছু হয়েই চলেছে। সদ্য দাড়ি কাটা মুখটা লাল করে স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে সৌম্য। ঠিক যেন লিফলেট-এ  আটকানো কোনো ওয়ান্টেডের ছবি। কোন মানে আছে রেল অবরোধ করার! তাও আবার ট্রেন বাতিল করার প্রতিবাদে। সৌম্যর চোখে মুখে বিরক্তি ভাব স্পষ্ট। আর দেখে দেখে আজকেই, ইন্টারভিউর দিনে, অবরোধ হতে হল। কখন ট্রেন আসবে কোন ঠিক নেই।

এমনিতেই সকালবেলা মায়ের সাথে একটু কথা কাটাকাটি হয়ে গেল, তার উপর এখন এই অবস্থা। ভালো লাগছে না। আর কথা কাটাকাটি হবে নাই বা কেন! সবসময় যদি কানের সামনে বলে, “বাবু এবার কিছু একটা চাকরি-বাকরি কর। দেখেছিস তো বাবা রিট্যায়ার হয়ে গেছে। কতদিন আর এভাবে চালাবে বলতো!”

এই কথা শুনতে আর ভালো লাগে না সৌম্যর। প্রতিদিন একই কথা শুনতে কারই বা ভালো লাগে। সৌম্য চাকরির চেষ্টা যে করছে না, সেটা নয়। কিন্তু এত ডিগ্রীর ভিড়ে সে এক দর্শক মাত্র। বরাবরই সাধারণ মানের ছাত্র। দৌড়ে চলেছে ভিড় ঠেলে।

স্টেশনে অনেক লোকের ভিড়। বেশিরভাগই অফিস যাত্রী। সবাই অপেক্ষা করছে ট্রেনের। কেউ কেউ স্টেশনে দাঁড়িয়েই তাস খেলা আরম্ভ করে দিয়েছে। সৌম্যর পাশে মাঝবয়স্ক লোকেদের একটা গ্রুপ দাঁড়িয়ে আছে। তারা রাজনৈতিক বিশ্লেষণে বেশ ব্যস্ত। রেল অবরোধের কারণ থেকে শুরু করে রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার, বিরোধী দলের ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে বেশ গবেষণা চলছে।

সৌম্যর ওদিকে মন নেই। ঠিক সময়ে ইন্টারভিউতে যেতে পারবে কিনা, তার মন ক্যালকুলেট করে চলেছে। উত্তর অজানা।

স্টেশনের পাশের চায়ের দোকানে এসে বসল সে। একটা সিগারেট কিনে চিন্তিত মুখে ধরাল। ফোনটা খুলে নেট অন করতেই রিয়ার বেশ কয়েকটা ম্যাসেজ ঢুকল। কাল রাতে একটু ঝামেলা হয়েছিল ওদের মধ্যে। রিয়ার আজকের সকালের ম্যাসেজে সরি কথাটা একাধিকবার দেখতে পেল সৌম্য। কোন রিপ্লাই না করেই ফোনটা পকেটে রেখে দিল সে।

সিগারেট টানতে টানতেই দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখতে পেল। এমন কিছু বয়স নয়। তার থেকে চার-পাঁচ বছরের ছোট হবে। লিফলেট বিলি করে বেড়াচ্ছে।
দোকানদারকে সিগারেটের পয়সা দিতে যাবে এমন সময় স্টেশনে announce শুনতে পেল। রেল অবরোধ উঠে গেছে। ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন আসবে। পয়সাটা দিয়ে বেশ খুশি মনেই সে আবার স্টেশনে এসে দাঁড়াল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দলের বিশেষজ্ঞ অফিসকর্মীরা তখন ক্রিকেটের আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত। ধোনির টিমে থাকা নিয়ে এইমুহূর্তে তাদের খুব চিন্তা।
ওদের কথা শুনছিল সৌম্য। হঠাৎ তার সামনে সেই ছেলেটা এসে একটা লিফলেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল। সৌম্য তাকিয়ে দেখলো কোন একটা NGO সংস্থার লিফলেট। পুরোটা পড়ল। আবার পড়ল। আরও একবার পড়ল। ট্রেন ঢুকছে স্টেশনে। সৌম্য আরও একবার পড়ল। আবারও পড়ল…

সৌম্যর বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব, রিয়া সবাই এসেছে। সৌম্যর লেখা প্রথম বই বেরোচ্ছে।
এখন সে প্রতিষ্ঠিত। আর ডিগ্রীর ভিড়ে সে দৌড়ায় না। যেদিন ইন্টারভিউ যাওয়ার ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছিল সেদিন থেকেই আর সে দৌড়ায় না।

রিয়া ঠিকই বলতো। অনেকবার বলেছিল একটা উপন্যাস লিখতে। সৌম্যই পাত্তা দেয়নি। এই নিয়ে ঝগড়াও করেছে মেয়েটার সাথে। এখন আর কোন অভিমান নেই রিয়ার মনে। এখন সে খুব খুশি।
মা এখন আর কিছু বলে না সৌম্যকে। মাঝে মাঝেই সৌম্যর প্রিয় আলুপোস্ত করে খাওয়ায়।

অনেক খুঁজেছিল কিন্তু সেই ছেলেটাকে আর কখনও দেখতে পায়নি সে। তবে সেই লিফলেটটা এখনও তার ডায়েরির ভাঁজে যত্ন করে রাখা আছে।
“এই মিথ্যে কথার শহরে, মাঝে মাঝে মনের গোপনে,
লুকিয়ে রাখা সত্যিটাও বলা দরকার।”

Facebook Comments Box

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *